একা ঈশ্বর
সকাল সাড়ে আটটা বাজে। ঘড়ির দিকে
একবার চোখ রেখেই হাতের খবরের কাগজটা ঝটপট ভাঁজ করে উঠে পড়লেন শান্তন বাবু। সেই ভোর
ছটা থেকে নিয়ে বসে আছেন। স্ত্রী নীপা আধ ঘণ্টা আগে দ্বিতীয় রাউণ্ডের চা দেওয়ার সময়
একবার তাড়া দিয়ে গেছেন।
-দু ঘণ্টা ধরে একটা কাগজে কি যে এত
পড় বুঝিনা।
-কাগজটা ঠিক মতো খুঁটিয়ে পড়তে গেলে
দু ঘণ্টা সময়টা বড্ড কম গিন্নী। কোনদিন পড়ে দেখ, বুঝতে পারবে।
-আমাকে কে আর মুখের সামনে চা ধরে
দিয়ে বিলাসিতার কাগজ পড়াবে বল? সকাল থেকে তো
ঠিক মতো চোখ খুলে ঠাকুর দর্শন করে প্রণামটুকু করারও সময় পাই না। তাই ওই পনেরো
মিনিটের চায়ের সাথে যতটা পড়তে পাড়া যায় তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
এরপর কর্তার সাথে মস্করার
অভিপ্রায়ে বলেন, তাছাড়া আমি তো আর তোমার মত উপরে
দেওয়া বিজ্ঞাপনের লক্ষী কড়াই, বাসুদেব ছাতা
থেকে শুরু করে শেষ পাতার সম্পাদকের নাম ও ছাপাখানার ঠিকানা অবধি পড়ি না। শুধু
জরুরী খবর টুকুই পড়ি।
-আমি মোটেও ওসব পড়ি না শ্রীমতী।
তোমার যত্ত আজগুবি কথা। নাও নাও তোমার ঠাট্টা শুনলে হবে না। আজ সোমবার। তাড়াতাড়ি
অফিস যাই। আজ একটা বড় অর্ডার পাওয়ার কথা আছে। দেখি ঠাকুর কি করেন। আজকাল তোমার মত
ওনারও মতি গতি বোঝা দায়। কখন যে কার উপর থেকে কৃপা দৃষ্টি তুলে নিয়ে কার উপর
ফেলবেন তা উনিই জানেন।
নীপা কপট রাগ দেখিয়ে বলেন, তোমার ভগবান কে নিয়ে এই তামাশা আমার বোধগম্য হয়না বাপু।
একদিকে ঘণ্টা ধরে হাত জোড় করে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় কর আবার অন্য দিকে এই সবও
বল।
-ব্যবসা… সবই ব্যবসা, বুঝলে গিন্নী। ও তুমি বুঝবে না। তাই বৃথা চেষ্টা না করে বরং আমার খাবারের
ব্যবস্থাটা কর। দেরী হয়ে গেছে আজ।
শান্তনু বাবু শেষের কথা গুলো বলতে
বলতে তড়িঘড়ি স্নানে ঢুকলেন।
বিগত কয়েকদিন ধরেই মর্নিং ওয়াকে
যাবার সময় বা অফিস যাবার পথে শান্তনু বাবু একজন ভবঘুরে প্রকৃতির লোককে দেখছেন
এলাকায়। বেশির ভাগ সময় তাঁর বাড়ির আশে পাশেই দেখতে পান। লোকটি চুপ করে এক জায়গায়
স্থির ভাবে বসে থাকে। খালি গা, উসকোখুসকো চুল, ঘোলাটে দৃষ্টি,পরনে পোশাক বলতে নোংরা শতচ্ছিন্ন একটা হাফ প্যান্ট। আষাঢ় মাস। যখন তখন বৃষ্টি
আসছে। কখনো বা চড়চড়ে রোদ্দুর। লোকটির যেন কোনদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। একই ভাবে
অবিচল হয়ে বসে থাকে দূরের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে। ওনার বেশ কৌতূহল হয়। ভাবেন না
নড়ে একটা মানুষ এইভাবে পাথরের মূর্তির মত ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক জায়গায় বসে থাকে কি
করে?
বাথরুমে যাওয়ারও প্রয়োজন অনুভব করে না! তাই আজ যখন অফিস
বেরবার মুখে দেখলেন ঠিক তাঁর বাড়ির উল্টো ফুটেই লোকটি তাঁরই বাড়ির দিকে তাকিয়ে বসে
আছে,
নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না। গাড়ি থামিয়ে কাঁচ নামিয়ে
লোকটিকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। আশ্চর্য জনক ভাবে লোকটি এক ডাকেই উঠে ওনার দিকে পায়ে
পায়ে এগিয়ে এল। এই প্রথম উনি তাকে নড়তে দেখলেন।
-তুই কে... কি চাস? কেনই বা এইভাবে বসে থাকিস? খাস না, ঘুমোস না। এমন কি বৃষ্টি, রোদ, দিন, রাত একই জায়গায় বসে থাকিস দেখেছি। কি চাই কি তোর? কিছু তো একটা খুঁজছিস।
-আমি বাঁচতে চাই। বাঁচতে চাই আমি।
খেয়ে পড়ে সুস্থ ভাবে বাঁচতে চাই। কিন্তু শরীর অশক্ত, কাজ করার ক্ষমতা আমার নেই। তাহলে ঠাকুর কি আমার দিকে মুখ তুলে একবারও তাকাবেন
না?
লোকটির কথা শুনে শান্তনু বাবু
প্রথমে চমকে ওঠেন।
-বলে কি এই ভবঘুরে? কাজ করে না, কম্ম করেনা, চাল চুলো নেই, অথচ বাঁচতে চায়! তাও আবার খেয়ে পড়ে সুস্থ ভাবে?
তবে শিল্পপতি মানুষ, কাজেই স্বাভাবিক ভাবেই আশপাশের মানুষ ও তাদের জীবনকে দেখার
আঙ্গিকও তাঁর অন্যান্য সাধারণ মানুষদের থেকে একটু আলাদা। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন, আমি যা বলব করতে পারবি? যেমন বলব তেমন চলবি তো? তাহলে আমি কথা
দিচ্ছি তোর খাওয়া পড়ার কোন অভাব হবে না। সুস্থ পথেই বাঁচতে পারবি।
অতো বড় গাড়ি বাড়ি যে লোকের তাঁর
কথা মিথ্যে হবে না এই বিশ্বাসে ভবঘুরে লোকটি মাথা নেড়ে সায় দেয় ওনার কথায়।
-তবে এক কাজ কর। ঐ যে সামনে মোড়ের
মাথায় শীতলা মায়ের মন্দিরটা দেখতে পাচ্ছিস, ওর উল্টো দিকের ফুটপাতে গিয়ে চুপ করে বসে পড়। নড়াচড়া করবি না এক্কেবারে। ঠিক
যেভাবে তুই রোজ বসে থাকিস সেইভাবে বসে থাকবি। ঝড়, জল,
রোদ্দুর… কোন কিছুতেই কিন্তু ঐ জায়গাটা ছেড়ে নড়া চলবে না।
এমন অদ্ভুত নিদান শুনে লোকটি
খানিক্ষন অবাক হয়ে শান্তনু বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে
যায় মন্দিরের উল্টো দিকের ফুটপাতটার দিকে। সন্ধেবেলা আটটা নাগাদ অফিস ফেরত শান্তনু
বাবু দেখেন লোকটি সেই এক ভাবে মন্দিরের মায়ের মূর্তির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বাবা
লোকনাথের বসার ভঙ্গীতে বসে আছে। পরের দিন সকালে মর্নিং ওয়াক সেরে ফেরার পথে দেখেন
কে যেন লোকটার সামনে একটা থার্মোকলের প্লেটে কয়েকটা বিস্কুট আর এক ভাঁড় চা রেখে
গেছে। পাশে একটা খবরের কাগজে দুটো সিঙ্গাপুরি কলা আর একটা ছোট পাঁচ টাকা দামের
পাউরুটিও দিয়েছে কেউ। কিন্তু লোকটা কোন খাবারেই হাত দেয়নি। সেই একই ভাবে বসে আছে
ঠাকুরের দিয়ে চোখ রেখে। শান্তনু বাবু মুচকি হেসে বাড়ির দিকে পা বাড়ান। এরপর
কয়েকদিন কাজের চাপে অতটা খুঁটিয়ে লক্ষ্য করার সময় পাননি। শনিবার সন্ধ্যে বেলা
ক্লাবে যাবার সময় দেখলেন কে বা কারা যেন লোকটির জন্য জামা, একটা ছেঁড়া মাদুর, ব্যবহৃত মিনারেল ওয়াটারের বোতল ও পুরনো প্লাস্টিকের থালা আর গ্লাস রেখে গেছে।
গাড়িটা রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে কাছে এসে দেখলেন কেউ একজন সামনের কচুরির দোকান
থেকে কিনে চারটে কচুরি আর ঘুগনিও দিয়ে গেছে। কিন্তু আশ্চর্য,এবারেও দেখলেন যে সে কিছুতে হাত দেয়নি। শান্তনু বাবুর সারা
মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। লোকটি যে ওনার কথার আসল মানে ধরতে পেরেছে সেটা দেখে খুব খুশি
হলেন।
ব্যবসার কাজে শান্তনু বাবু দিন
সাতেকের জন্য দিল্লী গেলেন। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফেরার পথে শীতলা মন্দিরের সামনে
এসে ওনার তো চক্ষু চড়কগাছ। এ কি দেখছেন তিনি! লোকটিকে ফুটপাতের যে জায়গাটায় বসতে
বলেছিলেন কে বা কারা সে জায়গায় মোটা প্লাস্টিক দিয়ে ওর মাথার উপর আর দুপাশ ঢেকে
একটা ছাউনি বানিয়ে দিয়েছে। মাদুরের উপর কাঁথা দিয়ে একটা ছোট্ট বিছানা মতোও করা
আছে। বেশ কয়েক বোতল জল রাখা একপাশে। ফল পাকুড় আর রান্না ও শুকনো খাবার মিলিয়ে বেশ
অনেক কিছুই রাখা আছে লোকটির সামনে। আরও দেখলেন লোকটা মাথা নিচু করে প্লাস্টিকের
প্লেট থেকে কি যেন পরম আগ্রহে তুলে তুলে খাচ্ছে। এই বিরল দৃশ্য দেখে শান্তনু বাবু
আর নিজেকে আটকাতে পারলেন না। গাড়ি থেকে নেমে পায়ে পায়ে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই
সে মুখ তুলে মৃদু হেসে শান্তনু বাবুর মুখের দিকে তাকাল। উনি দেখলেন লোকটির গলায়
দুটো গোড়ের মালা ঝুলছে। লোকটি তাঁকে ইশারায় মায়ের মন্দিরের দিকে দেখাল। যেন বলতে
চাইছে সবই মায়ের ইচ্ছে। তারপর মুখ নিচু করে আবার মন দিল পাতে মেখে রাখা দই চিঁড়ের
বাকি অংশের সৎকারে। বুঝলেন খুব শিগগিরি এই ভবঘুরে লোকটি বাবাজী গোছের কেউ একজন হতে
চলেছে।
শান্তনু বাবু মুচকি হেসে গাড়ির
দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে নিজেকে বললেন, ব্যবসাটা হওয়া নিয়ে কথা, তা সে ঠাকুরেই
নামেই হোক বা অন্য কোনভাবে। লোকটা খেতে তো পাচ্ছে, বেঁচে তো থাকবে সদুপায়ে। আজ সারা পৃথিবী জুড়ে ধর্মের নামে, ঈশ্বরের নামে যেভাবে ব্যবসা চলছে, মন্দিরে মন্দিরে ভাগ্য ফেরান বা যাতনা মুক্তির উপায়ের নামে
বিগ্রহকে চড়ান ভেট আত্মসাৎ করে যে ভাবে একটা সম্প্রদায় দিন দিন ফুলে ফেঁপে উঠছে, সেখানে এই নিরীহ ক্ষুধার্ত মানুষটাকে বাঁচাতে এই সামান্য
ছলনা করা যেতেই পারে।
(সমাপ্ত)
0 comments:
Post a Comment