Thursday, December 25, 2014

প্রবন্ধ ২


বাজার এবং অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা
ই ন্দ্র নী ল  সে ন গু প্ত

আমরা আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করে তার ফায়দা তুলব কিনা, দেশে সুপার মার্কেট ঢুকতে দেবো কিনা এ নিয়ে যত রাজনীতি হবে ততই আমরা পিছিয়ে যাব

যার যে বিদ্যায় বা ক্ষমতায় পারদর্শিতা আছে তাকে সেখানেই উৎকর্ষতা লাভ করতে হবে এবং ফল স্বরূপ উৎপাদিত পণ্য বা পরিষেবা বাজারজাত করতে হবে। বস্তুত এটাই বিশ্বায়নের মূল কথা- আর বিশ্বায়নের হাজার কুফল সত্ত্বেও অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বায়নের হাত থেকে অব্যাহতি পাবার লক্ষণ অন্তত আমার নজরে পড়ছে না।

আমি যে বাজারে যাই না তার কারণ কিন্তু এই নয় যে আমি বাজার করতে ভালবাসি না। আসলে গৃহিণীই আমাকে দিয়ে বাজার করাতে ভালোবাসেন না। ওর অভিযোগ যে আমি সস্তা খুঁজতে গিয়ে আসলে ঠকে আসি। কিন্তু কি করব? বাজারে গিয়ে মানুষ দরদাম করবে না, হয় নাকি? আর এটা তো সবাই জানে যে তুমি যত বেশি জিনিষ নেবে দাম ততই সস্তা হবে। তখন কি ছাই খেয়াল থাকে যে বাড়িতে আমরা দুটি মোটে প্রাণী। এ ছাড়াও আরও সমস্যা হয় তরকারি নিয়ে। পাঁচমিশেলি তরকারি রাঁধতে হলে একটু কুমড়ো একটু বেগুন কিছুটা সজনে ডাঁটা সামান্য আলু একটু বড়ি এইসব লাগে। কিন্তু বাজারে গলদঘর্ম হয়ে ঘুরতে ঘুরতে অতো মনে থাকলো না। ফলে হয়ত অতিকায় একটি লাউ সঙ্গে কিছুটা পুঁইডাঁটা এবং প্রচুর আলু পেঁয়াজ কিনে বাড়ি ফেরার পর ভুলটা বুঝতে পারলাম। ততোক্ষণে ভুল সংশোধনের জন্য গৃহিণী নিজেই আবার বাজারে রওনা দিয়েছেন। তাঁকে যেতেই হবে, কারণ একটি সুনির্দিষ্ট তরকারি তার মানসচক্ষে তিনি দেখতে পাচ্ছেন। সবকটি উপকরণ চাই। অন্যথা চলবে না। 

আমার প্রিয় রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য মহাশয়কে আমি যে কটি কারণে শ্রদ্ধা করি তার প্রধান হলো, তাঁর বাজারপ্রিয়তা। রন্ধন-ব্যঞ্জন-ভোজনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিকগুলি তাঁর নখদর্পণে- এ তাঁর লেখা পড়লেই বোঝা যায়। 

যাই হোক এক বিকেলে বন্ধু আশিসের পাল্লায় পড়ে ওঁর সঙ্গী হয়ে বাঁশদ্রোণী বাজারে গেছিলাম। যাচ্ছি শুনে সহধর্মিণী একেবারে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী ঠিক করে দিলেন। দুটি বেল- গরমের দিনে বরফ দিয়ে বেলপাতার নানা উপকার, একটি পাউরুটি এবং কিছু মিষ্টি কিনে ফিরলাম।

কিন্তু আসল বিষয়টা অন্য। বাজারে ঢেলে বিক্রি হচ্ছে চিনা আর অ্যামেরিকান আপেল। আমদানি করা। দাম যথাক্রমে ১৮০ ও ২২০ টাকা কিলো। অনেক জিনিষেরই খবর রাখি না। এটা নিশ্চয়ই নতুন কিছু নয়। কিন্তু আমি জানতাম না।


কিছুটা গর্ব হলো, আমাদের তাহলে আর্থিক অবস্থা ভালোই হয়েছে। অত দূর দেশ থেকে পরিবহণের পেছনে খরচা করেও প্রচুর পরিমাণে আমদানিকৃত সামগ্রী ফলের দোকানে শোভা পাচ্ছে। কিন্তু আমরা কিছু বেচতে পারছি কি?
ফল আমদানি করছি আর ঘরের ছেলেমেয়েদের অ্যামেরিকা ইয়োরোপ নিদেন পক্ষে দিল্লী, মুম্বাই, হায়দ্রাবাদ, ব্যাঙ্গালোর রপ্তানি করে বসে আছি, অথচ খোদ অ্যামেরিকাতেই ব্যাটারি থেকে বাল্ব, মাটির বাটি থেকে ছবির ফ্রেম, কম্পিউটার থেকে পেন্সিল, ইলেকট্রিক্যাল থেকে ইলেকট্রনিক্স, সমস্ত কিছু আমদানি করা হচ্ছে চিন নামক আমাদের প্রতিবেশী দেশ। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। জামাকাপড়ের আন্তর্জাতিক ব্যবসায় একচেটিয়া প্রাধান্য বাংলাদেশের। অথচ ভারতীয় বস্তুর হাতে গোনা প্রাধান্য। জেমস জুয়েল্রি বলতে পারব না, তবে কিছু জামাকাপড় ও ল্যাম্পশেড আর টুকটাক ঘর
সাজানোর মোমবাতি, জুট ব্যাগ, জুট কার্পেট ইত্যাদি নজরে এসেছে। অথচ প্রচুর চিনা পণ্য এমন দেখেছি যে একই মান পরিমাণের দেশি পণ্যের দাম ভারতে এক চতুর্থাংশ। 

আমরা আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করে তার ফায়দা তুলব কিনা, দেশে সুপার মার্কেট ঢুকতে দেবো কিনা এ নিয়ে যত রাজনীতি হবে ততই আমরা পিছিয়ে যাব। যে যুক্তি দেখানো হচ্ছে তা অনেকটা রেলগাড়ি চালু হলে ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানের চাকরি যাবে বা কম্পিউটার এলে কেরানির চাকরি যাবে গোছের যুক্তি। যা আদপে ধোপে টেঁকে না। সমস্ত কেনাবেচা যদি সংগঠিত ভাবে হয় তবে প্রচুর সেল ট্যাক্স ইনকাম ট্যাক্স ইত্যাদি সরকারী কোষাগার সমৃদ্ধ করবে যা থেকে অনেক কল্যাণমূলক কাজ হতে পারে। পণ্য উৎপাদন পরিবহণ নিশ্চিত করার জন্য সারাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা কোল্ড স্টোরেজ ইত্যাদি তৈরি হয়ে যাবে বাজারের প্রয়োজনে এবং বিনিয়োগে। যে পরিমাণ কর্ম সংস্থান হবে তাতে বহু মানুষের রুজি রোজগার নিশ্চিত হবে। চাষি এবং ক্ষুদ্রশিল্প উৎপাদিত বস্তুর নিয়মিত বাজার পাবে। খুচরো ব্যবসার নামে যে অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা আমাদের মহল্লাগুলোকে রাস্তাঘাটগুলোকে গ্রাস করছে তার হাত থেকে সাধারণ মানুষ অনেকটা রেহাই পাবে। কোন সভ্য দেশই বাজারের নামে ফুটপাথ দখল করে ট্যাক্স প্রদানকারী পথচারীদের জীবন বিপন্ন করে পথ চলতে বাধ্য করে না। 

আমাদের দেশে কোন জিনিস কিনলে তার মান সম্পর্কে এমন গ্যারান্টি কেউ দেবে না যাতে পয়সা ফেরত পাওয়া যায়, এমনকি মাল বদলেও নেওয়া যায়। কিন্তু অ্যামেরিকাতে কেনার পরে ফেরত দিয়ে পয়সা নেবার হক ক্রেতার সব সময় থাকে, সে জামাকাপড় বা মোটর গাড়ি যাই হোক না কেন। যথেষ্ট সময় পাওয়াও যায় সেজন্য। এই কারণেই স্বভাবতই বাজে মাল গছিয়ে পয়সা নেবার গল্প এদেশে চলে না। সামগ্রিকভাবে দেখতে গেলে এতে সবারই লাভ। নিশ্চিন্ত মনে কেনাকাটা করতে পারলে অর্থনীতির উন্নতি যতটা ঘটে তাতে ব্যবসাপাতির সামগ্রিক লাভ অনেক বেড়ে যায়। প্রতিযোগিতার ফলে মানেরও আকাশ পাতাল ফারাক ঘটে। 

কবে যে আমরা সাবালক হবো, কে জানে! অদূরদর্শী তাৎক্ষণিক ফাটকাবাজ ব্যবসায়ী, চিটিংবাজ আর তোলাবাজরাই আমাদের দেশে সততার শতকরার হিসেবটা গুলিয়ে দেয়। আমরা ঠকা আর ঠকানো দুটোকেই জাতীয় চরিত্রের অঙ্গ করে নিয়েছি। সবাই চটজলদি কিছু মুনাফা করে চম্পট দিতে ব্যস্ত। কবে কীভাবে মুক্তি আসবে কে জানে? আমরা না হতে পারলাম উৎকৃষ্ট পুঁজিবাদী, না আঁকড়াতে পারলাম উপযুক্ত সাম্যবাদ। না ঘরকা না ঘাটকা অভিমুখ বিহীন মানবগোষ্ঠী আমরা নিজের রূপে নিজেই পাগল, বিশ্বের দরবারে ঠাঁই পেতে অনেকটা পথ হাঁটা বাকী।


0 comments:

Post a Comment