Friday, September 19, 2014

ছোটগল্প ৩


ধ্বস
অ বি ন  সে ন

অবনী ঘুরে ঘুরে ছবি দেখছিল। বিপিনের আঁকা সব ছবিই মানুষের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের। বাহু, উরু, বস্তি-দেশ, স্তন, যোনি।কোথাও কোনো মুখের ছবি নেই। তার ছবিতে মানুষ নয়, আলাদা আলাদা করে যেন মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বেঁচে আছে

বনী কি করবে ভেবে উঠতে পারছে না। আরো কি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে নাকি বিপিনকে একবার মোবাইলে ধরবে, অবনী ঠিক করে উঠতে পারছে না এবং না পেরে সে বার বার তার হাতঘড়ি দেখছে। অবনী জানে এই ভাবে অপেক্ষা করতে কারতে তার বহু সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। গিয়েছে। এই তো বিপিনকেই সে দেখতে পাচ্ছে, কি ভাবে তার হাত ঘড়ির সময় তর তরিয়ে চলছে। তার বউ, বাচ্চা, সংসার তরতরিয়ে চলছে। এই যে এখন প্রায় সকাল। প্রায়। সে হাওড়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। তার চারপাশ দিয়ে এই যে এতো অজস্র মানুষের স্রোত চলে যাচ্ছে..অর্থাৎ সে ভাবছে সবাই কেমন চলছে, একটা চলমান চলচ্চিত্র হয়ে চলছে, কেবল মাত্র অবনীর সবকিছু থেমে আছে।থেমে থাকার একটা বোধের ভিতর সে বন্দী হয়ে আছে। কিন্তু কেন? অবনী অনেক বিচার, বিশ্লেষণ করেছে, অনুসন্ধান করেছে কিন্তু কোনো কুল কিনারা করে উঠতে পারেনি, অর্থাৎ বিন্দুবৎ থেমেই আছে।
অবনী অনেক ভেবে পকেট থেকে তার বহু পুরানো নোকিয়ার শাদা কালো মোবাইল ফোনটা বার করল। আর সেটি হাতে নিয়ে আরো কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল। ভাবল ফোন করবে কি করবে না..এমন দোটানা অবশ্য অবনীর নতুন নয়। এমনটা তার হামেশাই হয়। একবার ভাবল সে ফিরে যাবে!
না, না এ ভাবে হয় না। হতে পারে না।
তারপর ভাবল।
হবে..কেন হবে না?
বিপিনের ফোনে বেশ কিছুক্ষণ রিং হল। তারপর ও প্রান্ত থেকে ভরাট গলা উত্তর করল
বল !
অবনী বুঝতে পারল বিপিন তখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। অবনী তাও জানে । বিপিন লেট রাইজার। অবনী বুঝতে পারছে এই সময়ে ঘুম ভাঙিয়ে বিপিন কে সে বিরক্ত করছে। কিন্তু এতো সব দৈর্ঘ্য প্রস্থ ভাবার মতো মনের অবস্থা তখন অবনীর নেই। সে বলল
এখনো কেউ এলো না তো!!
কে ?
বিপিন প্রথমটায় যেন বুঝতে পারেনি। সে আবার রিপিট করল
কে?
অবনী বুঝতে পারছে যে বিপিনের বিরক্তির পারদ চড় চড় করে বেড়ে যাচ্ছে। সে কিছুটা তুতলে..কিছুটা মরিয়া হয়ে বলল
যার আসার কথা ছিল ! আমি তো সেই কখন থেকে হাওড়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি।
কথাটা শেষ করেই অবনী লক্ষ করল একজন ঠিক তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অবনী মেয়েটির চোখের দিকে তাকাল এবং তাকিয়েই কি বুঝল তা সে অবনী জানে। কিংবা মেয়েটি। অর্থাৎ দু-জনেই। অবনী ফোন ছেড়ে দিল। বিপিন কি বলল বা বলবে সে সব শোনার মতো আর কোনো উপলব্ধি তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। তার বুক ধড়াস ধড়াস করছিল। সে চারপাশটা একবার তাকিয়ে নিলো। দেখল। কেউ কি তাদের লক্ষ করছে? এবং তখনি অবনী আবিষ্কার করে তার সময় যেন আবার চলতে শুরু করেছে। অবনী কি ভেবেছিল?...মেয়েটি তাকে বলবে? “অবনী বাড়ি আছ ?” না মেয়েটি তেমন কিছু বলেনি। আসলে এমন কিছু বলার তো ছিল না! বলার থাকবেই বা কেন ? কিন্তু অবনীর বুকের ভিতর যেন একটা ভীরু সারঙ্গ ঘুরে কিংবা দৌড়ে বেড়াচ্ছিল। অবনী বার বার চতুর্দিকে তাকাচ্ছিল।
এতক্ষণে মেয়েটির নাম জেনে গিয়েছে অবনী। ধরা যাক তার নাম রুবি। ড্যামড স্মার্ট নয়। বরং নিতান্তই আটপৌরে। পরনে সুতির ছাপা সালোয়ার-কামিজ। কাঁধ ছাড়ানো চুল, পনিটেল করা। মুখ চোখ মানানসই। অবনীর চোখ ঝলসে না গেলেও চোখের আরাম অনুভব করেছে অবনী। অবনী ঢিলে ঢালা পাঞ্জাবী আর পুরানো ফেড হয়ে যাওয়া একটা জিনস পরেছে। কাঁধে কিট ব্যাগ। অন্য সময় হলে অবনী কে এক নিঃসঙ্গ, আত্মমগ্ন কবি বলে মনে হত। কিন্তু এই মুহূর্তে অবনী বর্ষার সবুজ ধানক্ষেতের মতো চনমনে। তার রোগা বুক কিছুটা উত্তেজিত।
টিকিট কাটাই ছিল। হাওড়া-দীঘা তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেসে তারা উঠে বসল। বসে অবনী কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করছিল। বিপিন তাকে বাসে যাবার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু অবনী ট্রেনেই যেতে চেয়েছিল। ট্রেনের আয়েসটা সে ষোলো আনা উপভোগ করে নিতে চায়। তবে একটা ভয় ছিল। ট্রেনে চেনা জানা লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার সম্ভাবনা বেশী।
বিপিন অবশ্য তাকে ভরসা দিয়েছিল।
এসব নিয়ে তোর ওত মাথা ঘামাবার দরকার নেই, তোর সঙ্গে যাকে দিচ্ছি অর্থাৎ রুবি খুব প্রফেশনাল, ও ঠিক ম্যানেজ করে নেবে।আরে ভাই, চেনা কারো সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে বলবি তোরা লুকিয়ে বিয়ে করেছিস, এখন হানিমুন কত্তে দীঘা যাচ্ছিস
অবনী বেলেছিলযদি বাড়িতে বলে দেয়?
দুর শালা, তোর বাড়িতে আবার কাকে বলবে?
তা অবশ্য ঠিক। অবনী ভেবেছে।
ভোরবেলা যখন সে বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল তখন সে মায়ের কাশির শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। ভোর বেলা মার এই কাশির দমকেই অবনীর ঘুম ভাঙে। অবনী শুনতে পায় কাশতে কাশতে মার প্রায় দম বন্ধ হয়ে যায়। একটা বাতাসের দলা, একটা বেদনার দলা যেন গলার ভিতর আটকে থাকে। মার। তারপর অবনীও খানিকটা খক খক করে কেসে নেয় যেন বলে দ্যাখো মা আমিও তোমার মতো কাশছি। অবনী যেন কেশে কেশে মাকে একটু সান্ত্বনা জানায়। মা আর অবনীর মধ্যে এ এক অদ্ভুত খেলা চলে। অবনী ভেবে দেখেছে তাদের এই বাড়িতে(?) সবাই অসুস্থ। তার স্বামী পরিত্যক্ত বড়দি, তার একটা বাচ্চা, মা, অবনী নিজে, সবাই অসুস্থ। এমন অসুখের বাড়ি যেন সারা পৃথিবীতে আর নেই। কিংবা আছে? তাতে কি এসে যায় অবনীর? শুধু তার ছোট বোন অনিমা বোধ হয় কিছুটা সুস্থ। তাই কি? অবনী ঠিক জানে না। তার সঙ্গে বেনের দেখা খুব একটা হয়না তেমন। অনিমা কি করে তা সে জানে না। শুনেছে কোথাও একটা চাকরি করে। কি চাকরি? অবনী জানে না। সেন্ট্রাল ক্যালকাটার একটা খুব ঘিঞ্জি পাড়ার এক বহু পুরানো ফ্ল্যাট বাড়িতে দুটো ঘর নিয়ে তারা থাকে। ভাড়া এখনো খুব কম। বোধ হয় শ-পাঁচেক। না হলে কি অবনী পারত? অবনী একটা ছোট কোম্পানির সেলসে আছে। যা পায় তাতে করে কোনো ক্রমে খেয়ে পরে বেঁচে থাকা চলে। হ্যাঁ, একেই ঠিক বেঁচে থাকা বলে! অবনী জানে! কয়েকদিন আগে অবনী নন্দনের একটা গাছের ছায়ায় কিছুটা জিরিয়ে নিচ্ছিল। সেখানেই বিপিনের সঙ্গে তার দেখা। বিপিনের সাজপোশাক দেখে সে বুঝতে পারছিল বিপিন বেশ বড়লোক হয়েছে। তবু বিপিন তাকে চিনতে পারল। বিপিন তার সেই স্কুল জীবনের ইয়ার দোস্ত। বিপিন তাকে দেখে বেশ হই হল্লা করল। অবনী দেখল বিপিন একেবারেই বদলায়নি। বিপিন বড় একটা অ্যাড এজেন্সি তে চাকরি করে। আর্টিস্ট।ভালো চাকরি। অবনী এমনটাকেই ভালো চাকরি বলে। বিপিনের নিজের স্টুডিও আছে। অবনীকে সে সেখানেই নিয়ে গেল। অবনীকে বলল
তুই একটু বস। ছবি দেখ। আমি একটু কাজ সেরে নিই।
অবনী ঘুরে ঘুরে ছবি দেখছিল। বিপিনের আঁকা সব ছবিই মানুষের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের। বাহু, উরু, বস্তি-দেশ, স্তন, যোনি।কোথাও কোনো মুখের ছবি নেই।  তার ছবিতে মানুষ নয়, আলাদা আলাদা করে যেন মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বেঁচে আছে। তারা সব শরীরের সীমানা ছাড়িয়ে বেঁচে আছে। অবনীর গা শির শির করছিল। উত্তেজনা লাগছিল।
বিপিন এসে তার কাঁধে হাত রাখল।
কি দেখছিস?
কোনো মুখ নেই ?
না!
কেন?
দ্যাখ আমরা যে ভাবে আংশিক বেঁচে আছি। অংশত বেঁচে আছি। এই সব বেঁছে থাকে, না- বেঁচে থাকার ছবি। আগে আমার বিশ্বাস হত না যে আমরা সম্পূর্ণ বেঁচে নেই। অংশত বেঁচে আছি। এখন মেনে হয় আমরা চব্বিশ ঘণ্টা সম্পূর্ণ বেঁচে নেই। এক একটা বিচ্ছিন্ন মুহূর্তে আমাদের এক একটা বিচ্ছিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বেঁচে থাকে। বাকি অংশ তখন মৃত। এ সব ছবির কথা ছাড়। তোর খবর কি?
অবনী বিপিনের মুখের দিকে দেখছিল। বিবিন যখন তার ছবির কথা বলছিল তখন যেন তার চোখ মুখের চেহারা বদলে যাচ্ছিল। সে বিপিন যেন আলাদা বিপিন।
অবনী বলল
খবর আর কি ? চলে যাচ্ছে। তোর ওই ছবির  আংশিক বেঁচে থাকার মতো।
বিয়ে থা ?
যা চাকরি করি তাতে নিজেরই চলে না! বউকে কি খাওয়াব?
চাকরি করা মেয়েকে বিয়ে করিস তবে!
বিপিন যেন মজা করল।
তা ছাড়া বউকে রাখব কোথায়? ফ্ল্যাটে তো দু খানা মাত্র ঘর। মা, দিদি, দিদির একটা বাচ্চা, বোন!
অবনীর নিজেকে খুব নিরস্ত্র মনে হচ্ছিল।
তাহলে প্রেম ট্রেম!
অবনী মাথা নিচু করে ঘাড় নাড়ল।
দুর শালা, এ প্রেম সে প্রেম নয়!
তবে?
কচি মাখন শালা! তুই চিরকাল ম্যাড়াই রয়ে গেলি। মাঝে মাঝে দীঘা কি ডায়মন্ড হারবার ঘুরে আসতে পারিস। week end tour
অবনী মুখ তুলল। বিপিনের মুখের দিকে তাকাল। অবনীর যেন লজ্জা করছিল। বিপিনের মুখে কোনো মালিন্য নেই।
অবনী আবার ঘাড় নাড়ল।
বিপিন অবনীর সামনে বসল। যেন ফিস ফির করে শলা পরামর্শ করছে এমন ভাবে বলল
নে শালা, আমিই তোকে একটা ট্রিট দিচ্ছি। দীঘা যাবি? একটা ভালো মাল আছে। আর পাঁচটা প্রফেশনালদের মতো না।
যা:, লোকে জানতে পারলে কি বলবে?
দুর ন্যাকা চৈতন কোথাকার ! কে কি বললে বে, সেই ভেবে বেঁচে আছিস! এই যে তুই এমন হতচ্ছাড়া ভাবে বেঁচে আছিস তাতে কোন বালের কি ছেঁড়া যাচ্ছে খবর রেখেছিস ? লোকের ভাবা ভাবি মারাচ্ছিস !
অবনী যেন বিপিনের সামনে কুঁকড়ে যাচ্ছিল। অবনী কি নীচে নামবে তবে? তা নয় কেন? অবনী কোন ওপরেই বা আছে? অবনী তার ভিতরে একটা গিরি-ধ্বস টের পাচ্ছিল। কোথাও তার ভিতরে একটা বালির বাঁধ যেন ভেঙে যাচ্ছিল। সে বলল
কি জানি ভাই, আমার যা কপাল! এ সব করতে গিয়ে কোথায় কি বাওয়াল মাচাবে? না, থাক।
থাকবে কেন? এতো ভাবার কি আছে গান্ডু! আমি আছি! তোর এই দুঃখী দুঃখী মুখ আমার ভালো লাগছে না। I want to make you smile বুঝলি। আমি রুবি কে ফোন করে দিচ্ছি। সামনে শনিবার প্রোগ্রাম পাক্কা।হোটেল খরচা তোর। আর, সব হয়ে গেলে ওর হাতে কিছু গুঁজে দিবি। আমি বলে দেবো। কম নেবে তোর থেকে।
বিপিন তার মোবাইলে নাম্বার খুঁজতে লাগল।
অবনী চাইছিল তাকে বারণ করতে। কিন্তু পারছে না। অবনী কিছুতেই মুখ দিয়ে কোনো কথা বার করতে পারছে না। না, কিছুতেই সে পারছে না। সে চেষ্টা বলার যে, বিপিন এ সব আমি পারব না। কিন্তু একটা দৃঢ় হাত যেন তার মুখ চেপে ধরছে ক্রমাগত।
অবনীর মুখ দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
রুবি ট্রেনে উঠেই বাথরুমে গিয়েছি। বাথরুম থেকে এসে অবনীর পাশে বসল। অবনী তাকে জানালার দিকের সিটটায় বাসতে দিল। রুবি তার গা ঘেঁষা ঘেঁষি করে বসল। অবনী লক্ষ করল রুবির সিঁথির কাছটায় হালকা সিঁদুর ছোঁয়ানো। হালকা হলেও দেখা যায়। অবনী কি আগে লক্ষ করেনি! না, রুবি বাথরুমে গিয়ে সিঁদুর ছুঁইয়ে এলো? অবনী মনে করতে পারছে না। অবনী যেন একটু নিশ্চিন্ত হল। যাক, তাদের এখন স্বামী-স্ত্রীর মতো দেখাচ্ছে।
রুবি কিছু একটা বলল। অবনী ভালো করে শুনতে পেল না। ট্রেনের শব্দ। অবনী আবার ভালো করে রুবির মুখের দিকে তাকাল। রুবির মুখে কোনো মালিন্য নেই। স্বাভাবিক ও সচ্ছল মুখ যেমন।
অবনী খুব ছেলেবেলায় একবার দীঘা গিয়েছিল। বাব, মা, দিদি, বোন সবাই মিলে। এখন আর সেসব কিছু ভালো মনে নেই।
অবনী বলল
আপনি...
তারপর শুধরে নিয়ে বলল
তুমি আগে দীঘা গিয়েছ, তাই না!
রুবি আবার তার দিকে তাকিয়ে মালিন্যহীন হাসল। বলল
ট্রেনে করে এই প্রথম। তুমি ?
আমার প্রথমই বলা যায়।
তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?
আমার তো বাড়ি নেই..বাড়ির কথা বলতে নেই...
বললে কি হয় ?
না, না বলতে নেই...
না, হয় বানিয়ে বানিয়ে বললে...এই যে তোমার নাম রুবি...! রুবি না হয়ে যদি অন্য কিছু হত!
তা ঠিক...
এমনি করে তাদের কথা শুরু হয়...
হোটেলের ঠিকানা বিপিনই দিয়ে দিয়েছিল। বেশ সস্তা। অবনীর খারাপ মনে হল না। রিসেপসানের কম বয়সী ছেলেটা তাদের দিকে মজার চোখ করে তাকাচ্ছিল। তারা যখন খাতায় স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় লিখছিল, ছেলেটি তখন একবার ফিক করে হাসল। অবনীর অস্বস্তি হচ্ছিল।
অবনী ঘরে ঢুকে ভাবতে বসল সে কি করবে? কি করতে হয়...? অবনী ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না...তার মনে হচ্ছিল সে এতদিন একটা মজা নদীর মতো ছিল, সহসা কোথা থেকে এক বেনো জল এসে গিয়েছে, তার চারপাশে যে বালির পাড়, সেই পাড়ে জলের তোড়..এখুনি বালির পাড়ে ধ্বস নামবে..ধ্বস নামলে কি হয় অবনী জানে না..কিংবা সেকি ধ্বস চাইছিল ?
রুবি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই আবার জানালার কাছে ফিরে গেল। গিয়ে পর্দাটা ভালো করে টেনে দিল। তার পর আবার ফিরে এলো। বলল
এখনি কি নেবে ?
কি?
সে রুবির মুখের দিকে তাকাল। এখন আর রুবির মুখ মালিন্যহীন নেই।
আমায় ? না, দুপুরে স্নান করে খেয়ে এসে..?
রুবির গলাও যেন পাল্টে গিয়েছে। অবনীর সেই বিপিনের ছবিগুলোর কথা মনে পড়ল। সেই সব আংশিক বেঁছে থাকা ছবি। রুবিরও যেন এখন সমস্তটা বেঁচে নেই। এই মুহূর্তে রুবির মন, স্তন, পাছা, যোনি..আংশিক মৃত হয়ে গিয়েছে। অবনী বললেই এখনি তাদের, সেই সব মৃতের গা থেকে পর্দা সরে যাবে, যেমনটা অবনী ছেয়েছিল, সেই সব নগ্ন স্তন, উরু.। হাত ছোঁয়ালেই তারা কি আবার বেঁচে উঠবে? অবনী কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। বুঝে উঠতে না পেরে অবনী হাঁপিয়ে উঠছিল। বলল
চলো, সমুদ্র দেখে আসি!
বলে সে রুবির মুখের দিকে তাকাল। রুবি মৃত প্রজাপতির মতো মৃদু হাসল।
তাই চলো।
তারা, সে দিকে লোকজনের একটু ভিড় কম, সেরকম একটি জায়গা খুঁজে সেই দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ একজনকে দেখে অবনী ভণ্ডুল হয়ে গেল। মেয়েটি?
অনিমা?
তার বোন?
না না অনিমা কেন হবে? ওর সঙ্গে ওটা কে?
না, না, অবনী ভুল দেখেছে। তার গলা চিরে একবার অনিমার নাম ধরে চিৎকার করতে ইচ্ছা করল। তার একবার মনে হল। ভুল। পরক্ষনেই তার মনে হল। না, না, ভুল না। অবনী কখনো রেগে যায় না। আজ তার ভীষণ রেগে যেতে ইচ্ছা করছিল। ভীষণ রাগ হচ্ছিল তার। রুবি তার হাত ধরেছিল। তার হাত কাঁপছিল। রুবি বলল
কি হল?
অবনী রুবির দিকে তাকাল। রুবি দেখল অবনীর চোখ লাল হয়ে গিয়েছে। রুবি কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।
অবনীর মনে হচ্ছিল তার সারা মুখ কুষ্ঠ রুগীর মতো যেন কুঁকড়ে যাচ্ছে। তার মাথার ভিতর ভীষণ এক বারুদ।
হঠাৎ কয়েকটি ছেলে ছোকরা, রুবিকে দেখিয়ে সিটি মারল।
অবনীর ভিতরকার বারুদ যেন এই টুকু স্ফুলিঙ্গের  অপেক্ষা করছিল। তার মাথার ভিতর এক বিশাল পাথরের ধ্বস নামল যেন। সে রুবির হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে যে ছেলেটি সিঁটি মারল তার কলার ধরে এলো মেলো মারতে লাগল। কিল । চড়। লাথি।
বাঞ্চত, মুখ ভেঙে দেবো তোদের।
তারাও তিন চারজন ছিল। তারাও কিল চড় মারতে লাগল। চারিদিক থেকে লোকজন দৌড়ে আসছিল। রুবি হাত ধরে টেনে নেবার চেষ্টা করছিল অবনীকে। পারছিল না। প্রকাশ্য বেলাভূমিতে, এক আকাশ রোদের নীচে অবনী, নিরস্ত্র অবনী ক্রমাগত লড়াই করছিল। কার সঙ্গে লড়াই? কিসের লড়াই?সেইসব বোধ অবনীর ছিল না! চেতনার শেষ বিন্দু পর্যন্ত অবনী লড়াই করল।






0 comments:

Post a Comment