ছবিঃ মৌমিতা ভট্টাচার্য |
হামিদালী টায়ারবার্স্ট
মা হ মু দ টো ক ন
মা হ মু দ টো ক ন
“শ্রেণিহীন মানুষদেরই বেশি বিপদে ফেলতে দেখেছে সে। তাছাড়া পরেশের মনে হতো, ইচ্ছে করলেই কেউ একজন মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না। তাহলে মানুষ কেন মানুষকে হত্যা করবে? মন থেকে সে কোনো দিন এটা মেনে নিতে পারেনি। এখনো সে বিশ্বাস করে হত্যা, ঘৃণা দিয়ে পরিবর্তন সম্ভব নয়”।
ঠিক সকাল দশটায় হামিদালী পরিবহণ এসে দাঁড়ায় ভুরঘাটা বাজার স্টেশনে। ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের ওপরে। পরেশ ডাক্তারের চেম্বারের কয়েক গজ সামনে। কাঁটায়-কাঁটায় এক ঘণ্টা লেট। তবুও বাস এলেই মানুষের মধ্যে একধরনের কোলাহল, ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। গ্রামের তাজা শাকসবজি, ফলমূলের বড়-বড় বস্তা, জিয়ল মাছের জেরগুলো গাড়ির ছাদে চেপে বসে, যেন তারাও অধীর আগ্রহে এতক্ষণ বসে ছিল শহরে যাবে বলে। সত্যিই তা-ই। মানুষ অপেক্ষা বস্তা, ড্রাম, পোটলাই এখান থেকে বেশি যায় রাজধানী ঢাকায়। একজন ব্যবসায়ী কুড়ি-ত্রিশটি বস্তা-ঝাঁকা বহন করে। চেয়ারালী একাই মাছের দশ-বারোটা ড্রাম উঠিয়ে গাড়ির ছাদ থেকে হাঁক ছাড়ে, : ‘ও ডাক্তার সাব, হাচেনরে কবেন কালকে পাবদার চালানডা য্যান অবশ্যই হামীদালীতে দ্যায়। আমরা গাবতলীরতে নামায়া নেবানে। মনে কইরা কবেন কিন্তু'!’ : ‘শালা বানচোত, তোর কথা আমি ক্যান কবো। আমার কি দায় পড়েছে তোর কথা বলতে? মাছ কিনতে গ্যালে তো ঠিকই দামটা চড়া রাখোস! তখন তো কস না যে ডাক্তার আপনের জন্য দু’টাকা কম।’ পরেশ ডাক্তার মনে-মনে গজগজ করতে থাকে। কিন্তু' চেয়ারালীর ওপরে তার রাগ না পড়তেই চেয়ারালী মধুবর্ষী কথাটি বলে পরেশকে, : ‘আরেকটা কাম করবেন, দাদা। কাইল এট্টু নশা’র মায়রে দেইক্যা আসবেন। বাতের ব্যতায় কাহিল কয়দিন ধরে। টাকা-পয়সা যা লাগে আমি আইসা দেবো। যাবেন কিন্তু' দাদা!’ : ‘হ, যাবানে। তয় আইজ পার্বম না, কাইল দশটার দিকে যাবো।’ কিছুটা কৃত্রিম উদাসীনতা ঝরে ডাক্তারের গলায়। আর দশটি স্বাভাবিক ঘটনার মতোই এটি, যেন এতে পরেশ ডাক্তারের কিছু এসে যায় না। কিন্তু'বিষয়টি আলাদা। নশা অর্থ্যাৎ নওশাদের মা মেহেরজানের অসুস্থতায় একটু বিচলিত হলেও পরেশ ডাক্তার তার দেখা পাবে বলে ভেতরে-ভেতরে প্রবল আনন্দিত। কতদিন দেখা হয় না। অধিকতর সতর্ক বলেই নিরাসক্ত গলায় উত্তর দিয়েছে সে চেয়ারালীর কথার। খুব ঘুরিয়ে জবাব দিতেও হয়, যাতে কোনোভাবে তার কৌতূহল প্রকাশ না পায়। রাস্তা কণ্টকহীন রাখতে পছন্দ করে পরেশ ডাক্তার। তার নিজের বেশ গোছানো সংসার। ঘরে বিদূষী বউ। ছেলে-মেয়ে দুটি ঢাকায় হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছে। সপ্তাহান্তে সে আর তার বউ মিলে রিকশায় বেড়াতে যায়। কোনোদিন এমনকি নাহার সিনেমা হলে ম্যাটিনি শো দেখে ফেলে। চাই কী চিনে খাবার খায় পর্দাটানা কেবিনে বসে। আজকাল গাঁও-গ্রামেও চিনে খাবারের জয়-জয়কার। আর উঠতি ছেলেমেয়েদের কাছে পোলাও-বিরিয়ানি থেকে বিদেশী খাবারের বেশ কদর। স্বাদে না হলেও নামে বেশ ঘ্রাণ। আভিজাত্য। তবে ভালো চিনে খাবারের স্বাদ পরেশের কাছেও বেশ উপভোগ্য। এ সকল মিলে ভালোই আছে পরেশ ডাক্তার। তার মতো মেহেরজানও অশান্তিতে নেই। কেবল চেয়ারালীর মতো খবিশ লোকটির স্ত্রী বলেই যা খামতি। নইলে দেয়াল তোলা টিনের চার বারান্দার ঘর। ঘরে বড়-বড় ধানের গোলা। লক্ষ্মীমন্ত তিনটি ছেলে-মেয়ে। তবুও পরেশ ডাক্তার বেশ বিবেচনা করে, এজন্য যে দুটি সংসারের জন্যই সামাজিক অবস্থান খুব গুর্বত্বপূর্ণ। তাছাড়া এই মূর্খ-গুবরে লোকগুলোর কোনো জ্ঞানগম্যিও নেই। কখন কাকে কী বলে ফেলবে, কী করবে। চেয়ারালীর চাচাত ভাই সিরাজ গত বছর আলিমদ্দি মেম্বরের ছেলেকে দড়ি বেঁধে টানতে-টানতে বাজারে নিয়ে এলো। দুনিয়ার লোকজন হামলে পড়লো কীর্তি দেখার জন্য। তাদের সামনেই বলে কি-না মেম্বরের ছেলে ওর বোনের ঘরে ঢুকেছিল। শালার বোনটি-ই যে বারোদুয়ারি সেদিকে খেয়াল নেই। কুড়ি বছর না পেরোতেই তিনখান নিকে শেষ। যাকে দেখে তার দিকেই নজর ফ্যালবে। ছোট-বড় সবার দিকেই তার নোলা। এমনকি পরেশকেও একবার দিন দুপুরে বলে বসলো, : ‘ও ডাক্তার, চলো তোমাক নিয়ে শহরে ভাইগে যাই। তোমার মুকখান দেখলেই বুকের মধ্যি ধরফর-ধরফর করে। এই হাত দিয়ে দ্যাখো’ - বলেই পরেশের হাত টেনে নেয় আর কী! : ‘আরে কী করছো, ছাড়-ছাড়! লোকে দেখলে কী অসম্মান!’ পরেশের ঘেন্না লাগে এরকম ছেনালি। ওই একবারই মাত্র চিকিৎসা দিয়েছিল পরেশ। আর ওমুখো হয় নি। রোগীর জ্বর সারাতে গিয়ে নিজেই গায়ে জ্বর নিয়ে ফিরেছিল আর কী। কিন্তু' মেহেরজান তার সাত রাজার ধন এক মাণিক। মেহেরের জন্য সব করতে পারে পরেশ ডাক্তার। এটুকু আছে বলেই তার এখনো গান শুনতে ভালো লাগে। নীল আকাশ দেখলে মনের কোথায় যেন কারো মুখ উঁকি দেয়। বাজারের বটগাছটায় নতুন পাতা এলে কেমন শূন্য-শূন্য ঠেকে। সে-কারণেই কালবৈশাখি ঝড় এলে নিজের বাড়ির আগে তার উৎকণ্ঠা চেয়ারালির বাড়ি কিছু হয় নি তো। এখনো চালতা গাছে ফুল এলে রাতে তার ঘুম হয় না ফুলের গন্ধে। সেটি কষ্টে - কী আনন্দে - তা বুঝতে পারে না এবং তা জানতেও চায় না পরেশ ডাক্তার। ওই ঘুম না হওয়াটুকুই তার কাছে গুর্বত্বপূর্ণ। হাতের তালুর ওপর চোখ রেখে আজও সে এ কারণে আয়ুরেখার দীর্ঘছাপ হাতড়ে বেড়ায়। দীর্ঘ জীবন বেঁচে থাকতে চায় সে এই আনন্দটুকুর জন্য।
চেয়ারালীর কথা শেষ, এর মধ্যেই ছক কষে ফ্যালে পরেশ ডাক্তার। চেয়ারালীর ভাই হাচেন ওই সময়টায় বাজারে থাকবে। মেয়ে তিনটি স্কুলে। বাড়িতে একা মেহেরজান। দুটি কাজের মেয়ে আছে বটে, তারা রোগী দেখার সময় ধারে-কাছে থাকে না। মেহেরজানের লতার মতো হাতখানি নিয়ে পরেশ ডাক্তার তখন গভীর আবেগে দেখতে থাকে। মেহেরের হাত ধরে নাড়ি দেখা যেন শেষ হতেই চায় না তার। পরেশের নিজের ঘরে সুন্দরী স্ত্রী। লোকে বলে প্রায় সুচিত্রা সেন। তবুও সাদামাটা মেহেরজান তার কাছে অপ্সরা। মেহেরজানকে দেখলেই তার ভেতর ঘণ্টায় হাজার মাইল বেগে ঝড় ওঠে। তার কথা বন্ধ হয়ে যায়। অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে ওঠে তার মন। প্রেম বুঝি একেই বলে!
মজিদবাড়ি প্রাইমারি স্কুলে দুজন একসঙ্গে পড়েছে। তারপর গোপালপুর হাইস্কুল। দুজনেই এক ক্লাসে। ক্লাসে পরেশের রোল নম্বর এক থেকে তিনের মধ্যে। মেহেরজান গোবর। প্রতি বছরই কমপক্ষে দুটি সাবজেক্টে ফেল। তারপরও টেনেটুনে ক্লাস নাইন। কিন্তু' প্রেম ততদিনে সার্টিফিকেট পেয়ে গেছে। বইয়ের মধ্যে চিঠি, কু-ুবাড়ির মেলায় উপহার, পড়া দেখানোর নাম করে দু-চারদিন পর পর দেখা দেয়া পুরোস্তর। তবে ওই পর্যন্তই। ধর্ম ভাঙার কিংবা ডিঙ্গোনোর সাহস পায়নি দুজনের একজনও। ভয় আর শংকায় ধর্মই জিতে গেছে। ততদিনে পরেশের উচ্চ মাধ্যমিক শেষ। তার ফল প্রকাশের পরপরই মেহেরজানেরই বিয়ে। পরেশ তার ভালো ফলাফল উদযাপনের আগেই বিষাদগ্রস্ত মন নিয়ে গ্রাম ছাড়ে। কষ্টে আর কান্নায় উদ্ভ্রান্ত দিন গেছে তার। দুটি বছর পাগলের মতো কেটেছে। তারপর সব আস্তে-আস্তে সয়ে এলো। আবার ফিরেছে নিজের গ্রামে। স্বপ্ন ছিল বড় ডাক্তার হবে। হতে পারেনি। হয়েছে গ্রাম্য বাজারের হোমিওপ্যাথ। এ নিয়ে মনের গহিনে গভীর আফসোস রয়েছে তার। তবে কাজটি পরেশ খুব মন দিয়ে করে। আন্তরিক অধ্যয়ন ও মনোযোগের কারণে তার হাত যশ খুব। দশ গ্রামের লোক এক নামে তাকে চেনে। আস্থা রাখে। শহর থেকে পাশ করে আসা অনেক ডাক্তার থেকেও পরেশের নামযশ কম নয়। অনেক ডাক্তারের ফ্যামিলির লোকজনও তার ওষুধ খায়। সুনাম করে। সেই সুনামের মর্যাদাও বেশ গুর্বত্বের পরেশের কাছে। মানুষকে সে সেবা দিতে চায়, নিজের সম্মানও চায়। তেমনি নিজের বউকে বঞ্চিত করতে চায় না, আবার মেহেরজানের ভালোবাসাও চায়। এর মধ্যে জটিল ভাবনার কোনো বিষয় খুঁজে পায় না পরেশ ডাক্তার। মানুষের জীবনে আনন্দটাই মূল বলে মনে হয় তার কাছে। কিন্তু' তার আনন্দে যেন অন্য কারো সমস্যা না হয় -
সেদিকেও খুব খেয়াল পরেশ ডাক্তারের। এই বিবেচনাবোধটুকু তার বেশ টনটনে হলেও মেহেরজানের প্রেমের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই। এখানে সে ফিদা!
চেয়ারালির সাথে কথা শেষ করে বাজারের ব্যাগটি হাতে করে বের হয় ডাক্তার। নিজের দোকান থেকে দশ গজ দূরেই মাছের বাজার। শীতের এ সময়টা বাংলার গ্রামাঞ্চল আসলেই ফলবান। বাজারে মাছ আর অন্যান্য জিনিসের কমতি নেই। ক্ষেতে-ক্ষেতে সবুজ শাকসবজির সমারোহ। মুলো, কপি, শিম, পালং। হালকা সবুজ-সাদা ছাপার কোমলমতি লাউ। ক্ষেতজুড়ে ফসলের আস্ফালন। গেরস্তের হাতে কাঁচা পয়সা। পরেশের ব্যবসাও। বেশ মাছ উঠেছে বাজারে, পাবদা, শিঙি। র্বপালি তেলওয়ালা দেশী চওড়া পুঁটি। তাজা মাছ লাফাচ্ছে কাশেমের ডালায়। বাজারের সবচে’ বড় মাছ বিক্রেতা কাশিরামের ডালায় পেলৱায় সাইজের একটি চিতল। এখনো জীবন্ত। সাপের মতো লেজ নাড়াচ্ছে রাজকীয় ভঙ্গিতে। খন্দকার বাড়ির বড়ভাই দর করছেন। উনি না নিলেই কেবল পরেশ ব্যাগে তুলবে, সে দাম যতই হাকুক কাশিরাম। বড়ভাই সকলের শ্রদ্ধাভাজন। দশগ্রামে সবাই মান্য করে। মানুষটিও অকৃত্রিম ভালো। বড়-বড় চাকরি করে অবশেষে নিজের গ্রামে ফিরে আবাস গেড়েছেন সপরিবারে। আশেপাশের সবার প্রতি তার সমান খেয়াল। কার ছেলে কী বিষয়ে পড়বে, কার গাছ নিয়ে বিবাদ কিংবা কোন জমি কী ফসলের উপযোগী এ সকল পরামর্শ বড়ভাইয়ের কাছ থেকেই নেবে মানুষ। এলাকার পুজো-মেহফিলের ব্যবসা কীভাবে হবে - সব তার মতামতের ওপর নির্ভর করে। সঙ্গে সবার সানন্দে অংশগ্রহণও নিশ্চিত করেন তিনি। বড়ভাই আছে মানে সবাই নির্ভার। পরেশকে দেখেই কাছে ডাকলেন, : ও পরেশ, আয়, আয় ভাই। মাছ নিবি তো? সরস্বতী কেমন আছে, তোর ছেলে-মেয়ে? পরেশের বউ সরস্বতী বড়ভাইকে খুব মান্যি করে। : ‘ভালো বড়ভাই। আপনে তো যান না অনেকদিন। সরস্বতী কচ্ছিলো। পরেশ আন্তরিকভাবে বলে, কিন্তু' তার চোখ চিতলের লেজে। লেজের বড়-বড় কালো ফোঁটাগুলো বাচ্চাদের কাজলের ফোঁটার মতো, যেন নজর না লাগে। পরেশের নজর লেগেই ছিল। বড়ভাই খেয়াল করলেন, কিরে, চিতল নিবি? নে, তুই চিতল নে, আমি বরং পাবদা নিই।: না-না, বড়ভাই আপনে নেন। লজ্জা পায় পরেশ। এজন্যই বড়ভাই অনবদ্য। মানুষের মনের কথাটি পর্যন্ত পড়ে ফেলেন। আবার অন্যের জন্য নিজের স্বার্থত্যাগ করতেও পারেন অনায়াসে। এই মানুষটির কাছেই ছাড়তে শিখেছে পরেশ। মূলত নিজের ভালোবাসার মেহেরজানকে সে ছাড়তে পেরেছে বড়ভাইকে দেখেই। নইলে মেহেরকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে পারতো পরেশ। চাই কী ভারতেও। সেখানে তার আত্মীয়রা রয়েছে অনেকে। কিন্তু' তাতে হিন্দু-মুসলমান মারামারি হতো। দাঙ্গাও লেগে যেতে পারতো। পরেশ এসব চিন্তা করেই নিজের স্বার্থ ভুলেছে। সে উৎসাহী হয়ে চিতলটি নিজ হাতে বড়ভাইয়ের ব্যাগে তুলে দিয়ে নিজেই দামটা মিটিয়ে দেয়। আর সেটি বৈধ করার জন্যই খুব আব্দারে ভঙ্গিতে বলে, : বড়ভাই, বৌদির হাতে পড়লেই চিতলের স্বাদ খুলবে। আমি আইজ দুপুরে সরস্বতীকে নিয়ে আপনের বাড়িতে যাবো। আজ আমার আর সরস্বতীর নেমন্তন্ন আপনের বাড়িতে। বড় ভাই হৈ-হৈ করেও পরেশকে থামাতে পারে না, শেষ পর্যন্ত পরেশ আর সরস্বতীর নিমন্ত্রণ নিশ্চিত করে তবেই পরেশকে ছাড়েন। এরকম ঘটনা ভুরঘাটা বাজারে নতুন কিছু নয়। প্রায়ই ঘটে। সেখানে বড়ভাই, কেষ্ট দাশ, পরেশ ডাক্তার কিংবা ইউনুস সর্দার এরকম সাধারণ ঘটনা প্রবাহের মধ্যেও অসাধারণ সম্পর্কের এক সেতুবন্ধন রচনা করে চলে। পরেশ চনমনে হৃদয়ে পাবদার ভাগা ব্যাগে ভরে নিজ দোকানের দিকে হাঁটা শুর্ব করে।
বড়ভাইকে কিছু দিতে পারার আনন্দ নিয়ে দোকানে ফিরতে ফিরতেই দ্যাখে সুবল খন্দকারের ছেলে আমিনুর। ইশ, আনন্দটা বেশিক্ষণ মনের মধ্যে আটকে রাখতে পারলো না। ছোড়াটাকে দেখেই মেজাজটা খিঁচড়ে ওঠে। বয়স কুড়ি কী বাইশ এর মধ্যেই ডেঁপো হয়ে উঠেছে। বদমায়েশির যত রকম মন্ত্র রয়েছে -
সব শিখে ফেলেছে, যাকে বলে শয়তানের গুর্ব। পটিয়ে-পটিয়ে উঠতি বয়সের মেয়েগুলোকে ফাঁদে ফেলে। এর মধ্যেই দুজনের পেট খসিয়েছে পরেশ ডাক্তার। আবার এরকম হলে ওকে পুলিশে দেবে বলেছে। হারামজাদা অকৃতজ্ঞও খুউব। এত সার্ভিস দেয়ার পরও পরেশের নামে গোপনে কুৎসা রটিয়েছে। পরেশকে এখন এলাকা জুড়ে ছেলে-ছোকড়ারা দূর থেকে হামিদালী টায়ারবার্স্ট বলে খেপায়। এমনকি প্রথম দিকে তার চেম্বারের আশেপাশেও লিখে রাখতো বদমাশটা।
তখন শীতকাল। রাত ৯টা বাজতেই গ্রামের লোকজন বাড়িমুখো। এ সময় রোগীদের বাড়বাড়ন্ত। শীতকালে ঠান্ডাজাতীয় রোগের প্রকোপ বেশি। এক রোগ থেকে আরেক রোগ। পরেশকে বেশ রাত পর্যন্ত রোগী দেখতে হয়। সেজন্য পরেশও বেশ প্রস'ত হয়ে বসে তার গদিআঁটা চেয়ারে। সাদা পাঞ্জাবির ওপর হাফহাতা জাম্পার গলিয়ে তার ওপর কাশ্মিরী শাল। এ অবস'ায় যে কেউ দেখলে পরেশকে একবাক্যে রাজনৈতিক নেতা বলে ভুল করবে। বন্ধুবান্ধবদের দু-একজন মশকরা করে নেতা বলে সম্বোধন করে তাকে এই পোশাকে দেখলে। পরেশের খারাপ লাগে না। অন্য দশজন থেকে রাজনীতি বিষয়ে সে বিস্তর খোঁজ-খবর রাখে। পড়াশোনাও কম নয়। ছাত্র বয়সে সংশিৱষ্টতাও ছিল। তবে নেতা হওয়ার ইচ্ছে কোনোদিন ছিল না তার। ডাক্তার হিসেবে পরিচিতিই ভালো লাগে। একধরনের প্রশান্তি আছে তার এজন্য।
এর মধ্যেই আশেপাশের দোকানগুলো ঝাঁপ ফেলেছে। বাজারে কোনো অনুষ্ঠানও ছিল না। মাঝে-মধ্যেই ভুরঘাটা বাজারে লক্ষণ দাসের সার্কাস কী পরিবার পরিকল্পনার প্রজেক্টর প্রমো নিদেনপক্ষে কবিয়াল গান একটা না একটা চলেই। কিছুদিন হলো এলাকায় উগ্রপনি'দের উৎপাত শুর্ব হয়েছে। এখানে-সেখানে সংঘর্ষ। বন্দুকযুদ্ধ। দু-একটা মৃত্যুসহ সহিংসতার খবর পাওয়া যায় প্রায়ই। পরেশের অবশ্য এ সবের ভয় নেই। ডাক্তার বলে কথা। রাতবিরেতে তাকে মাঝে-মধ্যে এ সকল ঝক্কি সইতে হয়। ওষুধ, ছোট কাটা-ছেঁড়া এগুলো নিয়ে অনেকেই আসে। পরেশ বোঝে কে কোথা থেকে আসে। পেশার কারণে দু-চার গ্রামের লোকজনও কমবেশি তার চেনা। কে কী সেটা থেকেও তার কাছে বেশি বিবেচ্য অসুস' মানুষ। ডাক্তার হিসেবে তার দায়িত্ব চিকিৎসা দেয়া। সে এখানে একদম দায়িত্বশীল। পরেশ যখন চেম্বারের ঝাঁপ লাগাবে, তখনোই ১৮-১৯ বছরের একটা ছেলে এসে ঢোকে। শুকনো মুখে খোঁচা-খোঁচা দাঁড়ি। উস্কোখুস্কো চুল। চাদর গায়ে। এক হাতে রক্তাক্ত একটা কাপড় জড়ানো। তবুও বেশ ভারি গলায় ছেলেটা বলে, : ডাক্তার সাহেব, স্যরি, আপনাকে একটু কষ্ট করে আমার হাতটা ব্যান্ডেজ করে দিতে হবে। আপনি বোধ হয় বের্বচ্ছিলেন? : না-না, আপনি ভেতরে আসুন। বসুন। আমার কাজই হচ্ছে চিকিৎসা দেয়া।’ কিছুটা বিড়ম্বিত হলেও বেশ আশ্বস্ততার স্বরেই উত্তর দেয় পরেশ। বোঝা যায় ছেলেটা নিষিদ্ধ দলের সদস্য। তারপরই দ্র্বততার সাথে তুলো, ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে পরেশ ডাক্তার। এখন হোমিও চিকিৎসকরাও এগুলো হরদম ব্যবহার করে। চারদিকে শুনশান। কেউ নেই আশেপাশের দোকানগুলোতে। দূর থেকে দু-একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ। পাহারাদারের হুঁইসেল শোনা যাচ্ছে। পরেশ বুঝতে পারে, ছেলেটা একা আসে নি। তার সঙ্গীরা নিশ্চয়ই আশেপাশে রয়েছে। নিরাপত্তার জন্য তারা সামনে আসেনি। হয়ত এ এলাকারও কেউ আছে। নইলে পরেশের দোকানে ছেলেটার এভাবে নিশ্চিন্তেঢুকে পড়ার কথা নয়। নিশ্চয়ই কেউ দেখিয়ে দিয়েছে। এসব ভাবতে-ভাবতেই পরেশ ছেলেটাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পেশেন্ট বেডে শুইয়ে দেয়। হাতখানা ভালো করে দেখে প্যাঁচানো গামছাটা খুলতে গেলেই অস্ফুট স্বরে ব্যথায় কাতরে ওঠে ছেলেটা। ছেলেটার হাতের গভীর ক্ষত দেখে পরেশের নিজের ছেলের মুখটা ভেসে ওঠে। এখন আর পরেশ ডাক্তার নয়, স্রেফ পিতা। বাৎসল্য ঘিরে আছে এ মুহূর্তেতাকে। প্রথমে গভীর ৰতটা পরিষ্কার করে, চারপাশে অ্যানেসে'শিয়া দিয়ে সেলাই করার উপযুক্ত করে - তবেই পরেশ কথা বলে, : কী করে এভাবে হাতটা কাটলেন? এভাবে তো সাধারণত কাটে না, নিশ্চয়ই কেউ আঘাত করেছে কিংবা কোনো দুর্ঘটনায় পড়েছেন? অভিজ্ঞতা থেকে বলে পরেশ ডাক্তার। ছেলেটা কিছুক্ষণ পরেশের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে জবাব দেয়, : কিভাবে বুঝলেন আপনি? : বাবা-মা সন্তানের অনেক কিছুই বোঝে। যুক্তিতক্কো পাশে রেখে আবেগী কণ্ঠে বলে পরেশ। নিজের অজান্তেই ডাক্তারের বদলে বাবা-মা শব্দটা উচ্চারণ করে সে। : সত্যিই। একটা অপারেশনে গিয়েছিলাম। জানেন, আমি লোকটাকে কিছুই বলি নি, কিন্তু' দরজা ঠেলে ঢুকতেই সে আমাকে আঘাত করে। ছেলেটি যেন তার কাছে নালিশ জানায়। : কিন্তু' বাবা, আত্মরক্ষার অধিকার তো সবারই রয়েছে। পরেশ সিরিয়াসলি কথাটা বলেই কিছুটা সতর্ক হয়ে যায়। এই বয়েসী ছেলে-ছোকড়াদের বোঝা বেশ কঠিন। কখন কী করে বসে! ছেলেটার মুখ-চোখ শক্ত হয়ে উঠলেও সে কোনো কথা বলে না। পরেশ দমে না গিয়ে আরো কিছুটা ডিফেন্সিভ হয়ে সেলাই করতে-করতেই ছেলেটার চোখে তাকিয়ে বলে, : ‘যে লোকটা আঘাত করেছে, নিজেকে তার জায়গায় রেখে -
ভেবে দেখুন তো আপনি হলে কী করতেন? চারদিকে বিপৱবের নামে যা হচ্ছে -
মানুষ আতঙ্কিত হবে না? আর নিরীহ বিপন্ন মানুষ জানমাল রক্ষার জন্য যে কোনো কিছু করতে পারে। এবার ছেলেটা কিছুটা নরম স্বরেই জবাব দেয়, : ‘আমি তো তাকে আঘাত করতে চাই নি। আমরা বরং কিছু সহযোগিতা পাবার আশায় গিয়েছিলাম।’ : ‘সেজন্য তো বাবা, বিশ্বাস আর আস্থার জায়গা তৈরি করতে হয়। মানুষ বুঝবে কী করে যে তুমি তার শত্রু না মিত্র? তোমরা যে ওই মানুষটার জন্য বিপজ্জনক নও বরং তাদের জন্যই কাজ করছো - সেটা কি প্রমাণ করতে পেরেছ, বলো? আর তোমার বয়সই বা কত? এখন তোমার পড়ালেখা করার বয়স। সমাজ পরিবর্তন করতে এলে সেই সমাজটাকে আগে ভালোমতো জানতে হয়, বাবা। অন্য দেশের উদাহরণ কি আমাদের দেশের জন্য অপরিহার্য? কথাগুলো একনাগাড়ে বলে পরেশ ডাক্তার নিজেই অবাক হয়। এত গুছিয়ে এবং মোক্ষম কথাটা বলতে পেরে তার বেশ স্বস্তি লাগে। আপনি থেকে ছেলেটাকে তুমি সম্বোধন করে সে নিজের অজান্তেই। তারপর ছেলেটার মুখের চোখের ভাষা পড়ে আবার শুর্ব করে, : বিপ্লব করতে হলে নিজেকেও প্রস'ত করতে হয়, জানো? কেবলমাত্র সুশিক্ষিত জ্ঞানী মানুষের নেতৃত্বই বিপ্লবের জন্য উপযুক্ত। এরাই সমাজকে বদলাতে পারে। বিপ্লব সফল করতে পারে। নইলে রক্তপাতই বাড়ে। কোন লাভ হয় না। কথাগুলো কিন্তু' আমার নয়, বইয়ের। কোথা থেকে পরেশ ডাক্তার এত সাহস পেল - সে জানে না। কিন্তু' বহুদিন এই কথা সে বলতে চেয়েছে। শ্রোতা পায়নি। আজ যেন জায়গামতো মোক্ষম কথাটি বলতে পারলো। এখন পরেশ ডাক্তারের মুখে এক অলৌকিকতৃপ্তির মায়াজাল। এখন সে কোনো কিছুর তোয়াক্কা করে না। যা যৌক্তিক যা মানুষের জন্য কল্যাণকর - সেটি বলতেই হবে। তা সে নিষিদ্ধ কী সিদ্ধ - যে পার্টিরই লোক হোক। সেলাই শেষ হলে ছেলেটাও উঠে বসে। তার দুচোখে এখন ক্লান্তি। পরেশ বোঝে, এত যন্ত্রণার পরে ছেলেটার এখন বিশ্রাম আর খাবার প্রয়োজন। পরেশের খুব ইচ্ছে করে ছেলেটাকে বাড়ি নিয়ে যায়। যত্ন করে খাওয়ায়। বিছানা পেতে ঘুমুতে দেয়। কিন্তু' সে জানে - এটি আদৌ সম্ভব নয়। পার্টি এবং পুলিশ দুদিক থেকেই ঝক্কি রয়েছে। ছেলেটাও কিছু ভাবছিল। হঠাৎ এদিক-ওদিক মাথাটা নেড়ে পরেশের কাছে পানি খেতে চায় সে, : ‘কাকা, একটু পানি খাওয়াতে পারবেন? ছেলেটাও ‘ডাক্তার সাহেব’ না বলে সম্বোধন বদলায়। : আনছি বলেই পরেশ পানি ঢালে গৱাসে। তারপর নিজের জন্যে রাখা কৌটো থেকে কয়েকটা বিস্কুট আর একটি কলা এগিয়ে দেয়। ছেলেটিকে খেতে দিয়ে তার জন্য দরকারি ওষুধ প্যাকেট করতে থাকে। পরেশের বাৎসল্য টের পেয়ে ছেলেটি কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে খাবার আর পানি পান করে উঠে দাঁড়ায়। তারপর অনুচ্চ স্বরে বলে, : ‘আপনার কথা শুনে খুব ভালো লাগলো। আমার বাবা এভাবে আপনার মতো করে কথা বলেন। আপনার কথা মনে থাকবে আমার। বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে। বলে পকেটে হাত দিয়ে কিছু জিনিস বের করে আনে। তার মধ্যে কিছু দুমড়ানো টাকার নোট, ময়লা র্বমাল, একটি বুলেট আর মাথা ব্যথায় ব্যবহৃত অয়েন্টমেন্টের কৌটো। সেখান থেকে আস্তে-আস্তে এক হাত দিয়ে টাকাগুলো আলাদা করে পরেশের টেবিলে রাখে। অন্য জিনিসগুলো পকেটে ঢুকিয়ে আর দাঁড়ায় না। পরেশের দিকে একপলক তাকিয়ে দরজা খুলে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। বাইরের কুয়াশা আর অন্ধকার গিলে ফেলে ছেলেটাকে। পরেশের বুক ফুঁড়ে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। চোখে জল। চোখ মুছতে-মুছতে পরেশ বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। টর্চের আলো ফেলতে-ফেলতে বাড়ির রাস্তায় উঠে আর আলো জ্বালতে ইচ্ছে হয় না পরেশের। ভূতগ্রস্তের মতো পা ফেলে হাঁটতে থাকে সে কুয়াশা ভেদ করে। আকাশের মাঝখানে ক্ষয়াটে চাঁদ। কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে রাতটাকে ভৌতিক করে তুলেছে। একাকী উদ্ভ্রান্তের মতো পথচলা আর ছেলেটার মায়াময় র্বক্ষ মুখের ব্যথার ছাপ সবকিছু মিলিয়ে তার খুব এলোমেলো লাগে। মনে পড়ে মেহেরজানের বিয়ের পরে গ্রাম থেকে পালিয়ে এরকম একটা গ্র্বপের সাথে ভিড়ে গিয়েছিল পরেশ। উদ্দেশ্যবিহীন এরকম পথে-পথে সংঘর্ষ আর মৃত্যু তাকে ত্যক্ত করে তুলেছিল তিন মাসের মধ্যেই। সমাজ বদল ও সাম্যের কথা বললেও তার সঙ্গীরা নিজেরাই নিজেদের দলের মধ্যে তার চর্চা করেনি। অযথাই মানুষকে আঘাত করা, হত্যা করা একদম মেনে নিতে পারেনি পরেশ। শ্রেণিহীন মানুষদেরই বেশি বিপদে ফেলতে দেখেছে সে। তাছাড়া পরেশের মনে হতো, ইচ্ছে করলেই কেউ একজন মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না। তাহলে মানুষ কেন মানুষকে হত্যা করবে? মন থেকে সে কোনো দিন এটা মেনে নিতে পারেনি। এখনো সে বিশ্বাস করে হত্যা, ঘৃণা দিয়ে পরিবর্তন সম্ভব নয়। মানুষকে ভালোবাসার কোনো বিকল্প নেই। মানুষকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবেসে তবেই পরিবর্তন সম্ভব। পরেশ ডাক্তার গ্রামে ফিরে মানুষকে ভালোবাসার কাজটা করতে চেয়েছে মন দিয়ে। একদম তার নিজের মতো করে। এখনো তার সেই চেষ্টা অব্যাহত। পরেশের খুব ভয় হয় ছেলেটার জন্য। ছেলেটা কি তার মতো কুহক থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে? বেছে নিতে পারবে তার স্বপ্নের পথ, যাতে মৃত্যু আর হিংসা নেই, আছে ভালোবাসা আর জীবনের জয়গান। ভাবতে-ভাবতে পরেশ ডাক্তার বাড়ি ফেরার সারাজীবনের চেনা পথটিকে আর চিনতে পারে না। কোনদিকে তার বাড়ি, কোন পথে সে যাবে - তার হিসেব না করে কুয়াশা নির্মিত পথে সে হাঁটতে থাকে নির্বিকারভাবে। পথটাকে আর অনিশ্চিত মনে হয় না। সে জানে, এই কুয়াশা এই অন্ধকারের পরে নিশ্চিত একটা সূর্যালোকসিক্ত দিন আসবে।
ছেলেটাকে চিকিৎসা দেবার পরদিনই পাশের গ্রামে পুলিশের সঙ্গে একটা দলের গোলাগুলিতে একজন মারা পড়ে। খবরটা শুনে পরেশের বুকের ভেতর আনচান করে। চিন্তায় মুখভার হয়ে থাকে। সে রোগী দেখায় মন দিতে পারে না। উৎকণ্ঠায় একবার দোকানে বসে, পরক্ষণেই আবার বাইরে আসে, যদি কোনো নতুন খবর পায়। রাস্তায় উঠে একটা জটলা দেখে এগিয়ে যায় পরেশ, তখনোই ভয়ঙ্কর শব্দে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। পরপর দুটো বিকট শব্দ। আচমকা ভয়ে-শংকায় পরেশ নিজের চেম্বারের দিকে দৌড় দেয়। কোনো কিছুতে পা হড়কে পড়ে যায় রাস্তার মাঝখানে। লোকজন দৌড়ে এসে তাকে ওঠায়। আশ্বস্ত করে বলে যে, হামিদালী পরিবহনের টায়ার বার্স্ট হয়েছে। একসঙ্গে দুটো। আর তখনই কোথা থেকে আমিনুর ছোড়াটা উদয় হয়। এসেই পরেশকে ধরে। দোকানের দিকে নিয়ে যেতে-যেতে
প্রশ্ন করে, : ‘কী হইলো কাকা, বেমক্কা চিৎপটাং হইয়া পইড়া গেলেন যে? : আরে কী আর কবো, ওই হামিদালী টায়ারবার্স্ট! তখনও সে পরিসি'তি সামলে ওঠেনি। শরীর কাঁপছিল। আতঙ্কিত স্বরে কথাটাও ঠিকভাবে শেষও করতে পারেনি। ব্যস, আর যায় কোথায়! পরেশ দোকানে বসতে না বসতেই আমিনুর বাজারময় ছড়িয়ে দেয়। পরেশ ডাক্তার - হামিদালী টায়ারবার্স্ট। ওই শুর্ব। তারপর থেকে পরেশ ডাক্তারের নাম হয়ে গেল হামিদালী টায়ারবার্স্ট। হারামজাদা নিজে কোনো দিন মুখোমুখি বলতে সাহস পায় না। কিন্তু' ছেলেপুলেদের লেলিয়ে দেয়। দেয়ালে লিখে রাখে। এজন্য মাঝে-মাঝে ইচ্ছে করে, ভুল ওষুধ দিয়ে ওকে জন্মের মতো জব্দ করে। কিন্তু' পরেশ ডাক্তার সেটা চাইলেই পারে না। ভেতরে সে একটা কোমল হৃদয় ধারণ করে আছে। মানুষের অপকারের শেকড় সেখান থেকে মুলোচ্ছেদ করা। সে চাইলেও পারে না অথবা সে হয়ত মানুষের ক্ষতি চাইতেই জানে না।
দোকানে ঢুকতেই দাঁত কেলাচ্ছে আমিনুর। ভাবখানা এমন, যেন মহান কোনো কাজ সে করে এসেছে। : ‘কাকু কেমন আছেন? কাকিমা ভালো? অনেক সময় ধরে আপনের জন্য বইসা আছি।’ : ‘হারামজাদা তুই দাঁত বন্ধ কর। আইছোস তো নিশ্চয়ই কোনো আকাম কইরা। আবার হাসোছ!’ ভেতরে-ভেতরে গজরাতে থাকে পরেশ। নিজে-নিজে কথা বলার সুবিধা আছে। রাগ কমে এবং যাকে ইচ্ছা যা খুশি বলা যায়। তাছাড়া সে ডাক্তার মানুষ, ভালো-মন্দ সবই তার ব্যবসার অঙ্গ। সেজন্য স্বর ও মেজাজ ঠান্ডা রেখে স্বাভাবিকভাবেই বলে, : ভালো। এক শব্দে সকল প্রশ্ন কাভার করে পরেশ বেশ ভারি গলায়। : বলো, কী সমস্যা? তুমি তো ভালো কাম নিয়া আসো নাই। কিছুটা যেন আঁচ করেই বিরক্ত স্বরে বলে চেম্বারের ভেতরে ঢুকে যায় পরেশ ডাক্তার। : ‘আর কবেন না, কাকা। সমস্যা কিছু না। তয় আমার একটু অসুবিধা দেখা দিছে। কয়েক দিন যাবৎ পায়খানায় বসে কোঁথ দিলে প্রস্রাবের সাথে সাদা-সাদা পানি বের হয়।’ অনেকটা আতংক নিয়ে বলে আমিনুর। : ইহাকে বীর্য বলে। বেশ ভারিক্কি চালে তার ডাক্তারি ভাষায় স্টেটমেন্ট দেয় ডাক্তার। তারপর অন্য রোগীরা যাতে না শোনে - এরকম গলা নামিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, : এই বয়সে এরকম অনাচার নির্বিচারে চালাইয়া গেলে অচিরেই ধ্বজভঙ্গ খাইবা মিয়া। স্বভাব-চরিত্ত ভালো করো। অনাচার বন্ধ করো। অন্যের সব্বোনাশ করতে-করতে তোমার নিজের সব্বোনাশও আসন্ন! এবার লাগাম টানো।’ এই ভাষায় পরেশ উচ্ছনে-যাওয়া ছেলে-ছোকড়াদের সতর্ক করবে। এরপর ওষুধ দেবে। উপদেশও দেবে। আর ওষুধ নেবার পরে অর্ধেক দাম দিয়ে আমিনুর বলবে যে, তার কাছে আর টাকা নেই। বাকিটা হাঁটবারে দেবে। সেই হাঁটবার আর কোনোদিন আসে না। এটিও এখানকার নৈমিত্তিক চিত্র। তাই বলে পরেশ ওষুধ দেয়া বন্ধ করবে না। এলাকার দরিদ্র মধ্যবিত্ত মানুষ পরেশের কাছে আসে এজন্যই। তারা জানে, পরেশ ডাক্তার ফেরায় না। এই আস'াটুকু পরেশের পশার আর এলাকার রোগীদের জন্য নির্ভরতা। মানুষের মানবিক ভুল-ত্র্বটি আর মীমাংসার মধ্য দিয়ে ভুরঘাটা বাসস্ট্যান্ডের পূর্বপাশের শতবর্ষী বটগাছের ফাঁক দিয়ে রোজ তবু সূর্য ওঠে। ভোর ৬টার মধ্যেই বাজার বসে। পোঁ-পোঁ ভেঁপু বাজিয়ে শহরগামী বাস এসে থামে। সেই ভেঁপুর সুর নতুন-নতুন ফর্ম পেয়ে ইংরেজি হর্ন নাম পেয়েছে। বেশ ভারিক্কি ইংরেজি নাম। কলেজের ছেলেরা, ’ইশ এত জোরে হর্নবাজছে’ বলে তর্বণী ক্লাসমেটদের কাছে ক্রেডিট নেয়। ঢাকাগামী বাসের ভেঁপু বাজলেই গমগম করে ওঠে চান্দু ফকিরের বাস কাউন্টার। মানুষের অপেক্ষার বিরক্তিতে চাঞ্চল্য ফিরে আসে। সাড়ে তিন ফুট উচ্চতার চান্দু তখন তার দ্বিগুণ উচ্চতার কন্ডাকটরকে ধমকে বলবে, : ‘বাস একঘণ্টা লেট। প্যাসেঞ্জারের গাইল কি ব্যাডা তুই হুনবি, বাঞ্চোত!’ এমন হেসে-হেসে গালিটা দেয় চান্দু যে উল্টো কন্ডাক্টর ‘কাকু-কাকু’ বলে জড়িয়ে ধরে। তারপর তাকে বগলের নিচে আটকে এয়াকুব খন্দকারের ঝুপড়ি হোটেলে। সেখানে মুরগির পাখনার ঝোল দিয়ে গরম পরোটা আর খাঁটি দুধের চা শেষ হলে তবে বাস ছাড়বে। এর মধ্যে মাছের ড্রাম, পটলের বস্তা, নারকোল, কলার কাঁদি, শাকসবজি সব বাসে চড়ে বসে। তাতে কোনটি শাকের আঁটির বস্তা, কোনটি যাত্রী - তা বুঝতে সময় লাগে। বাসটা ছেড়ে যাবার পরে পুরো স্টেশন জুড়ে নিস্তব্ধতা। চুপচাপ। নিঃসঙ্গতা মুড়ে থাকে কিছুটা সময়। বাজারের শতবর্ষী অশত্থের ঝরা পাতার শব্দও যেন পাওয়া যায় তখন। এরপর সকল স্টেশনের মতো আবার প্রাণচাঞ্চল্য শুর্ব হয় ভুরঘাটা বাজারে অন্য কোনো যানবাহনের ভেঁপু বাজলে।
প্রাইমারি স্কুলের ঘণ্টাধ্বনি শুনে দেয়ালে ঘড়ির দিকে তাকায় পরেশ ডাক্তার। কাঁটায়-কাঁটায় এগারোটা। হরিপদ দপ্তরি অন টাইম। স্কুলের আশেপাশের যাদের ঘড়ি নেই - তারা হরিপদর ঘণ্টায় একশ পারসেন্ট আস'াবান। ভোর ৭টা টু বিকেল ৫টা। জমিজমা সংক্রান্ত মামলায় হাজিরা দিতে যাওয়া কী ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো - তাতে হরিপদ ঘণ্টাই নিশ্চিত। হরিপদ ঘণ্টা এখন এলাকার ট্রেডমার্ক। নিজেদের ঘড়ি থেকেও লোকজনের কাছে বিশ্বস্ত ঘণ্টা ধরেই পরেশ ডাক্তার তার ব্যাগ আর কিছু জিনিসপত্র
নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এর মধ্যেই তার বাজার-সদাই বাড়ি পাঠানো হয়ে গেছে। মেহেরজানের জন্য মুড়ির মোয়া আর বীরেনের সন্দেশও ভরেছে ব্যাগে। কয়েকটা তেঁতুলের আচার নিতেও ভুল হয় না। সে জানে, মেহেরের পছন্দ-অপছন্দ। ইচ্ছে করলেই পরেশ সাইকেল রিকশায় চেপে যেতে পারে। এখন গ্রামেও রাস্তা আর যানবাহনের বাড়বাড়ন্ত। কিন্তু' পরেশ ধীরে-সুসে' হেঁটে যাবে। মানুষের সাথে কথা বলবে। দুপাশের ফসল দেখতে-দেখতে পথ হাঁটবে। এমন কী কেউ ডাক্তার সামনে পেয়ে পেট ব্যথার ওষুধ চাইলেও সে ফেরাবে না। এতেই তার আনন্দ। এই আনন্দতৃষ্ণা তার কখনো মেটে না ।
মেহেরজানদের বাড়ির পুকুরের সামনে এসেই চোখে পড়ে কয়েকটা ৮-১০ বছরের ছেলেমেয়ের জটলা। প্রায় সবার হাতেই বই-খাতা। মর্নিং শিফট স্কুল থেকে ফিরেছে হয়ত। তাদের মধ্যে দলনেতা গোছের দুজন হাতা গুটিয়ে উত্তেজিতভাবে ঢিল ছুড়ছে পুকুরের জলে। : কী হয়েছে, কী হয়েছে? বলে ওদের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ায় পরেশ ডাক্তার। : ডাক্তার কাকু, বিশাল একটা সাপ। ওইটাকে মারতেই হইবে আজকে। নেতাদের একজন উত্তর দেয়ার আগেই জলের মধ্যে হলুদ কালো ছোপছোপ একটি বড় সাইজের ঢোঁড়া সাপ চোখে পড়ে পরেশ ডাক্তারের। খুবই মনোমুগ্ধকর আঁকাবাঁকা ভঙ্গিতে জলমগ্ন একটা ঝোপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঢোঁড়া সাপ বিষাক্ত নয়। মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয় আদৌ । শুধুমাত্র নামটাই সাপ। এ কারণেই মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ভয় পায়। হঠাৎই পরেশ ডাক্তারের সেদিনের পার্টির ছেলেটার কথা মনে পড়ে, যেন সে-ও ক্ষতিকর নয়। ঘর ছেড়েছে বৈষম্যহীন সমাজ-প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। মানুষের কল্যাণের ব্রত নিয়ে পথে বেরিয়েছে এই তর্বণ, কিন্তু' মানুষই তাকে ভয়পায়। বিশ্বাস করতে পারে না। ভাবতে-ভাবতেই পরেশ ছেলেমেয়েদের থামায়। তারপর তার স্বভাবসুলভ উপদেশের ভঙ্গিতে কথা বলা শুর্ব করে ছোটদের সঙ্গে। : ‘তোমরা কি জানো যে সব সাপ মানুষের জন্য ৰতিকর নয়? এখন যে সাপটা তোমরা দেখছ - এর নাম ঢোঁড়া সাপ। এটা বিষাক্ত নয় এবং মানুষের কোনো ক্ষতিও করে না। তোমরা হয়ত জানো না যে এটা বরং আমাদের পরিবেশের জন্য উপকারী। তোমরা আর কখনো এরকম সাপকে আঘাত করো না। তাছাড়া বিষাক্ত সাপ হলেও কাছে যাবে না এভাবে। তাতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’ ছেলেমেয়েরা পরেশের কথায় খুব একটা আনন্দ পায় না। তাদের মধ্যে সাপ মারার একটা বুনো আনন্দ দেখা দিয়েছিল। পরেশ যেন তাতে বাধ সাধলো। পরেশের কথায় খুব উৎসাহ না পেলেও ঢিল ছোড়া থেকে বিরত হয়ে চলে যাচ্ছিল তারা। পরেশ ডাকলো তাদের। পড়াশোনার খবর নিলো। তারপর সবার হাতে একটা করে আচারের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে ছোটদের আনন্দিত মুখ দেখতে-দেখতে সে চেয়ারালীর বাড়ি প্রবেশ করে। তাকে অবাক করে দিয়েই উঠোনে দাঁড়ানো মেহেরজান বলে ওঠে, : কী ডাক্তারসাব পোলাপানের সাথে কী মিটিং করলা এতক্ষণ? অনেকক্ষণ ধরে দেখছিলাম। তা, কোথায় যাচ্ছিলে? যেন মেহেরজান পরেশের আসার সংবাদ জানেই না। : মানুষের ওপর গোয়েন্দাগিরি করছ তাহলে? ঘরে উঠতে-উঠতে হাস্যচ্ছলে বলে পরেশ। : ‘তোমার জন্য এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ডাক্তার। জানতাম, আজ তুমি আসবা। গতকাল যখন আসো নাই, আজ নিশ্চিত আসবা! আস্তে করে জবাব দেয় মেহেরজান। তারপরই কাজের মেয়েকে ডেকে ডাক্তারের জন্য চা-নাস্তার আয়োজন করতে বলে রোগী হয়ে বসে। : রোগটোগ কিচ্ছু না ডাক্তার, অনেকদিন তোমারে দেখি না, মনটা খুব পুড়ছিল। তাই নশার বাপেরে কলাম যে আমার পায়ের ব্যথা বাড়ছে, তোমারে য্যান আসতে কয়। ফিসফিস করে কথা বলে মেহেরজান। ব্যাগ থেকে স্টেথোসকোপটা বের করতে-করতে ডাক্তারসুলভ কপট গাম্ভীর্য মুখে এনে পরেশ ডাক্তার ধীরে-ধীরে বলে, : অবস্থা দেখে তো ভালো মনে হচ্ছে না। ইহা অতিশয় জটিল মানসিক রোগ। এর নাম - প্রেমরোগ। সঙ্গে-সঙ্গে মেহেরজান আতঙ্কিতভাবে ডাক্তারের হাত ধরে বলে, : হায়-হায় কী কচ্ছেন, এই রোগ সারবে তো মশাই হামিদালী টায়ারবার্স্ট! এই প্রথম কথাটা শুনে পরেশ ডাক্তার বিরক্ত তো হলোই না বরং খুব ভাবাবেগে তার প্রেমিকাকে বুকে জড়িয়ে হা-হা করে হাসতে থাকে।
0 comments:
Post a Comment