ডোর
প বি ত্র আ চা র্য্য
প বি ত্র আ চা র্য্য
“বাবুর চোখে এক নদী জল টলটল করতে দেখেছি সেই সময়। নিজের অসহয়তাকে লাঘব করার
জন্যে একজন সহৃদয় বন্ধুর দরকার ছিল। আর বাবু যেন লতার অবলম্বন দণ্ডের মত আঁকড়ে
ধরেছিল আমায়। আর আমিও সাহায্য করেছি কারণে অকারণে”।
[এক]
অফিস ঘড়িতে বিকাল চারটে। সুপর্ণা এসে বলে গেল বেরনোর
আগে ঠিক মনে করে যেন স্ট্যাটাস রিপোর্টটা ডেলিভার করে যাই ক্লাইন্টকে। মাসের শেষ।
তাই সাথে টাইম শীট আর বিলিং রিপোর্টটাও যাতে পাঠাতে ভুল না করি । প্রতি মাসের এই
দিনটাতে রিপোর্ট না পেলে মাই’বাপ অযথা রেগে যেতে পারেন।
একেতো শুক্রবার। সকাল থেকেই কাজে মন নেই। তার উপরে
নিজের কাজের বাইরে অন্যের কাজের উপর্যুপরি দায়িত্ব। এইসব উৎকট ঝামেলা একদম পোষায়
না। তবুও সুপর্ণাকে না করতে পারলাম না। একেতো মহিলা কলিগ। সুন্দরী, ভীষণভাবে ন্যাকাষষ্ঠি। আমরা একই বছরে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছি বটে। কিন্তু
কর্মসূত্রে ম্যাডাম আমার ঊর্ধ্বতন। তাই ইনিয়ে বিনিয়ে মিথ্যা কথা চালাতে পারলাম না।
একবার বলাতেই ঘাড় নেড়ে জানালাম, ঠিক ইমেল করে যাব। কোন কাজে ‘না’ করাটা এখনো ঠিকভাবে শিখে উঠতে
পারলাম না। ভালোভাবে না করাটা কর্পোরেট লাইফে একপ্রকার কঠিন শিল্প। এই কাজে হড়কে
গেলে উপর মহলের হুড়কো খেতে হবে। আর মধু মাখিয়ে পাশ কাটাতে পারলে বেশ কেল্লাফতে।
নিরীহ গো-বেচারা মুখে বোঝাতে হবে, কাজটা করতে পারলে খুব ভালই
হত। কিন্তু আমার নিজের প্লেটে এত কাজ তাই আর করে উঠতে পারব না।
একটানা কাজ করে মাথাটা বেশ টনটন করেছে। এরপরে বসে থাকলে
মনে হয় মাথার রগটা ছিঁড়ে যাবে নিশ্চিত। কাজটা মোটামুটি সাল্টে দিয়েছি। এখন শুধু
মেলটা ফরম্যাট করতে হবে। আর ডকুমেন্ট দুটো অ্যাটাচ করে সেন্ট করাটাই বাকী। এবারে
অন্তত একটা মিনি ব্রেক নেওয়াই যেতে পারে। ড্রয়ার থেকে
চীনামাটির কাপটা বের করলাম। টলমলে পায়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম ভেন্ডিং মেশিনের
দিকে। কাপটা রাখলাম মেশিনের এমিটার ঠিক নিচে আর প্রেস করলাম ক্যাপুচিনোর বাটনে।
ধুস! একগাদা গরমজল বেরিয়ে এলো। সাথে না কফি, না দুধ। কাপ থেকে জল
ফেলে দিয়ে পুনরায় চেষ্টা করলাম। এবারে গলগল করে বেরিয়ে এলো ক্যাপুচিনো। কোনো ফেনার
লেশ মাত্র নেই। অত্যন্ত সাধারণ, দুধে গোলা কফি মনে হল। চুমুক
মারতেই করকরে চিনি। কি জানি বাপু, এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারেও
চিনির দাম নেমে গেল নাকি! এই এক জ্বালা এই মেশিনে চা কিংবা কফি খেতে এলে। অন্যদিন
নিচে অফিস পাড়ার ঝুপ’স চায়ের দোকানেই যাই। এককাপ স্পেশাল চা
আর সাথে টানা দুটো গোল্ড ফ্লেক মাইলস মেরে তবেই উপরে ওঠা। আজ ওদিকে পা মাড়ানোর গতি
না থাকায় একপ্রকার বাধ্য হয়েই এই ভেন্ডিং মেশিন। মাথার ঝিকুটটা নড়ে গিয়ে মেজাজটা
খিঁচড়ে গেল। যেন মনে হল খিস্তি খেউড় করে আসি অ্যাডমিনের সাথে। এইরকম নাস্তানুবাদ
সুবিধা দেওয়ার কি মানে আছে? তারপর নিজে নিজেই ঠাণ্ডা হলাম।
সীটে ফিরে এসে কিছুতেই ভাল লাগছে না মেলটা টাইপ করতে।
এর মধ্যেই আবীর দুবার ঢুঁ মেরে গেছে। যদি দারু প্রোগ্রাম করা যায় আজ। মেজোটা কড়কে
থাকায় একটু বাজে ভাবেই বললাম,
- প্লীজ
একটু মন দিয়ে কাজটা করতে দাও। ইটস ভেরী আর্জেন্ট। আর প্রত্যেক উইক এন্ডে যাওয়ার কি
খুব দরকার আছে?
- না
মানে আমরা যাচ্ছিলাম। তাই ভাবলাম তুমি যদি যাও?
- দেখ
আমি মোটেও মালখোর নই। কালে ভদ্রে তোমাদের সাথ দিতে পারি। রোজ রোজ দয়া করে আমাকে না
বললেও চলবে।
শেষ কথাটার ঝাঁঝ অতিশয় রুক্ষ ছিল। তাই বুকটা খচখচ করে
উঠল। এভাবে না বললেও হয়তো চলত। মেলটা টাইপ করে সেন্ট করলাম। তারপর আর মুহূর্তের
বিলম্ব নয়। সোজা ডেস্কটপ শাটডাউন করলাম। অফিসের টু ডু লিস্ট ডায়েরিটা ড্রয়ারে রাখার
পর বন্ধ করলাম ডেস্ক। চাবিটা কুড়িয়ে নিলাম প্যান্টের পকেটে। লিফট লবিতে এসে
অপেক্ষা করতে লাগলাম। নিচে নেমে
দাঁড়িয়ে পড়লাম গেটের সামনে। গেটের সামনে গিজগিজে লোকের ভিড়। প্রবল বৃষ্টি থেকে
মাথা বাঁচানোর ধান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সবাই।
কোলকাতা শহরের এই এক অদ্ভুদ জায়গা। নাম অফিসপাড়া। আদর
করে এর নাম দেওয়া হয়েছে নবদিগন্ত। ব্যাঙের হিসুতেও এখানে বন্যা হয়ে যায়। গেটের
বাইরে চোখ যেতেই পিলে চমকে উঠল। অফিসপাড়া এই মুহূর্তে জলমগ্ন ভেনিস। চারিদিকে জলে
টই-টম্বুর। সামনের দিকে রাস্তায় অটোগুলো যেন একপ্রকারে ভেসেই চলেছে নৌকার মত দুলে
দুলে। বিকালের এই সময় বাড়ি ফেরার তাগিদে অটোতে ওঠার লাইন বেশ দীর্ঘ। তারপরে
ঠেলাঠেলিও কম নয়। এই অবস্থায় গাড়ির ক্ষতি হবে বলে বেশির ভাগ অটোই সটকে পড়েছে।
রেশন দোকানের চেয়েও দীর্ঘ, অটোলাইনে দাঁড়াবার জন্য মন সাথ দিলো না। গেটের সামনে বেশ কিছুক্ষণ
দাঁড়াবার পর বাইরের খরশান বৃষ্টির তেজ কমে ঝিরঝিরে হয়ে আসায় বেরিয়ে পড়লাম। ছাতা
নেই সাথে। তাই ভেজাটাই সম্বল। গোটাতে গোটাতে ফুলপ্যান্টটাকে পায়ের হাঁটুর উপরে
তুলে নিলাম। ঠিক যেন হাফপ্যান্ট পরেই চলছি। শহরের নালা নর্দামার ভরপুর জলে ছলাৎ
ছলাৎ শব্দ করে চলা। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে চোখে মুখে। স্ট্রীট
লাইটের আলোর প্রতিবিম্ব পড়েছে জলে। জলস্রোতের টানে খণ্ড বিখণ্ড লাইটের প্রতিবিম্ব
শতধা বিদীর্ণ শহরের মুখ বলে মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তে শুধু মনে হচ্ছে কখন বাড়ি ফিরব
। যত তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারি ততই ভালো।
এস.ডি.এফ মোড়
থেকে হেঁটে এলাম কলেজ মোড়। ওখান থেকে রোজকার মত সাটেলের জন্যে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ
কাঁধের উপর একটা হাত এসে পড়ল। চেনা মুখ। তবুও অচেনা। কেমন যেন গুবলেট মনে হচ্ছে।
অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম,
- কে
বলুন তো?
ঠিক চিনতে পারলাম না আপনাকে।
- তুই
ঋদ্ধি তো?
- আরও
গুলিয়ে গেল। সোজাসুজি তুই তোকারি করছে। হ্যাঁ, আমি ঋদ্ধি।
- চিনতে
পারলি না তো? আমি বাবু...শুভঙ্কর সেন।
- এবারে
স্মৃতির পাতা আরেকটু বেশি করে ঘাঁটতে লাগলাম। এই এক অদ্ভুদ রোগ আমার। চট করে ভুলে
যাই সবার নাম। অনেক কসরতের পর পেটে এলেও মুখে আসতে চায় না। এবারে জোর ধাক্কা খেলাম
ভিতরে ভিতরে। একী সেই বাবু...আমার হস্টেল লাইফের। আরে বাবু মানে...সিলিকন ভ্যালীর
বাবু?
আমি ঠিক বলছি তো?
- হ্যাঁ
রে। যাক অবশেষে চিনতে পেরেছিস তাহলে?
- কী
আশ্চর্য! অ্যাদ্দিন পর দেখা। কলেজ ছাড়ার পর প্রায় একযুগ হয়ে গেল। কোন যোগাযোগই
নেই। এইরকম ঝিরকুট্টে মেরে গেছিস কেন? আর আছিস কেমন?
- এই
কোন মতে বেঁচেবর্তে আছি। আর বলিস না অনেক ঝড় ঝাপটা যাচ্ছে আমার উপর এই সময়। একদিন
সময় করে সব বলব তোকে।
- তুই
থাকিস কোথায়?
- এই
তো নিউটাউনে মেস।
- তা
একদিন আয় না আমার এখানে জমিয়ে গল্প গুজব করা যাবে। আমার ফোন নাম্বারটা রাখ। আমি
হলদিরামের কাছেই থাকি। তোর মেস থেকে খুব একটা দূর নয়। যেকোনো উইক এণ্ডে বসা যেতেই
পারে।
- ঠিক
আছে বসব। তোর সময় হবে তো?
- দূর
দূর কি যে ভুল ভাল বলিস। পুরনো বন্ধুর জন্যে আবার সময়। আর আমি কোন হুনু রে? সামান্য আই.টির চাকুরে। তাতে আবার সময়-অসময়!
হঠাৎ বৃষ্টির তেজ যেন আরও বেড়ে গেল। প্রবল বৃষ্টির
ফোঁটা বর্শাফলকের মত ঝকঝকে হয়ে ছুটে আসছে। তেরছা অনমনীয় বৃষ্টির ফোঁটা গিথছে মুখের
চামড়ার ভিতর। আকাশের কোল ঘেঁসে এলোপাথাড়ি তরবারি চালাচ্ছে অশান্ত দানব
বিদ্যুৎরেখা।
বহুক্ষণ পর একটা সাটেল গাড়ি আসায় সবাই হুড়মুড় করে উঠতে
লাগলো। এই সময়কার প্রতিযোগিতা বিরাট কঠিন। ঠেলেঠুলে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন না করতে
পারলে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অবশেষে প্রতিযোগিতায় সফল হয়ে উঠে
পড়লাম। বাবু নিচে দাঁড়িয়ে নিঃস্পন্দ। কিছুটা হলেও স্বার্থপরের মত বললাম, টাটা। তুই পরেরটায় আয় আমি চলি।
গাড়ির ভিতরটায় বাকী জনতা সবাই কাকভেজা। জামা-প্যান্ট, জুতো সমস্ত শরীর জলে জ্যাবজ্যাব করছে। সবাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যতদূর সম্ভব
জল ঝেড়ে ফেলা যায়। কিছুদূর চলার পর মনে পড়তে লাগল বাবুর শুকিয়ে যাওয়া ঢলঢলে মুখটা।
কলেজের চারটে বছর নিপাট বাবুয়ানায় থাকা মানুষটির একী হাল! তারপরে কিছু একটা বলতে
চেয়েও বলতে পারল না। শুধু যেন অজানা এক রহস্যের ইঙ্গিত দিয়ে গেল ঝড় ঝাপটা কথাটা
শুনিয়ে। বাড়ি ফিরে এসে থেকে থেকে মনে পড়তে লাগল আমার ইঞ্জিনিয়ারিং এর চারটে বছর।
বিদ্যাসাগর ছাত্রাবাস। বাবু। সিলিকন ভ্যালীর কথা।
[দুই]
মাস দুয়েক পর। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ। এই সময়টা অফিস
বেরনোর অতিশয় তাড়া থাকে। সকালে বিট্টুকে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে আসার পর হাতে গোনা
যতটুকু সময় পড়ে থেকে রুদ্ধশ্বাসে তৈরী হতে হয় অফিস যাবার জন্যে। আজকাল অফিসে আবার
নতুন ঢঙ শুরু হয়েছে। ম্যানুয়াল এন্ট্রি বাদ দিয়ে ইলেকট্রনিক ইন-আউট টাইম সোয়াপ
করতে হচ্ছে। তাই চাইলেও ঢোকা আর বেরনোর সময় ফাঁকি দেওয়া চলবে না। একবার
ম্যানেজারের কুনজরে চলে এলেই বারোটা পাঁচ বেজে যাবে। আপ্রেজাল, প্রোমোশন সব এক্কেবারে ঘেঁটে ঘ। তাই বহুদিনের কু-অভ্যাস অফিস লেট থেকে
একটু নড়ে চড়ে বসা। সকাল বেলায় তড়িঘড়ি করে সব কিছু রেডি করে একেবারে দে’ছুট। খুব দেরী হলেও ন’টার বাস ধরা চাই।
গতকাল রাতে অফিস থেকে ফিরে আইডেন্টিটি কার্ডটা কোথায়
রেখেছি,
কিছুতেই মনে করতে পারছি না। ঘড়ির কাটা যেন সাঁ সাঁ করে চলেছে
সুপারসনিক বেগে। সময়ের এই এক অদ্ভুদ রোগ। যখন সময়ের আগমনটা ধীর হলে ভাল হয় তখনই
জোটে যত ঝুটঝামেলা। সময় ছুটতে থাকে তড়িৎ বেগে। আর যখন সময় কাটতে চায় না, মনে হয় সময় দ্রুত চলুক সময়ের ডানা যেন ঝুলে পড়ে বুড়ো মানুষের মত। কত শ্লথ
এর গতি! মানুষ কোনদিন নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না সময়কে। উপরন্ত সময়ের দাস হয়ে কাটাতে
হয় চিরটাকাল।
তন্নতন্ন করে খুঁজে না পাওয়ায় অবেশেষে দীপ্তিকে ডাকলাম।
টিফিন বাক্সের ঢাকনা আটকে রাখার কটাং করে শব্দটা পেলাম। দীপ্তির হাত ফাঁকা হয়েছে
বোধহয়! হাতের কাজ সেরে দীপ্তি এবারে গজগজ করতে করতে এগিয়ে এলো,
- সাতসকালে
এতো চেঁচাচ্ছ কেন?
- আরে
আই কার্ডটা পাচ্ছি না কোথাও?
- কালকের
প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দীপ্তি একবারেই পেয়ে গেল। তারপর মুখ ঝামটা দিয়ে বলল এই
এক দোষ তোমার। ঘটের বুদ্ধিটা একটুও কাজে লাগাবে না। শুধু হাউমাউ করতে থাকবে।
- অশেষ
ধন্যবাদ।
- হুম।
তাড়াহুড়ো করে বেরতে গিয়ে মোবাইলটা ছেড়ে এলাম শোবার ঘরে।
জুতো পরে বেরনোর সময় দীপ্তি ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল, - তোমার কল।
- কার
ফোন?
- আমি
কি করে জানব?
- হ্যালো, কে?
- আমি
বাবু বলছি রে। এবারে নিশ্চয় চিনতে ভুল করবি না? গলার আওয়াজ নিশ্চয়ই
বুঝতে পারবি?
- হ্যাঁ
রে।
- আজ
কি তোর সাথে দেখা করা যাবে?
- কোথায়
দেখা করবি বল? অফিসপাড়া না বাড়ি?
- যদি
বলি তোর বাড়ি?
- আমার
কোন আপত্তি নেই। তবে তুই রাত আটটার পরে আসতে পারবি?
- হ্যাঁ।
আমার কোন অসুবিধে নেই। যদি তোর কোন অসুবিধে না থাকে?
- আমার
আবার কি অসুবিধে? তুই এলে আমার দারুণ লাগবে। আর শোন
ডিনার কিন্তু এখানেই করে যাস।
দীপ্তিকে রাতের প্রোগ্রামের কথা বলেই ছুট লাগালাম
অফিসের দিকে। বললাম অফিস পৌঁছে ফোন করে বলে দেব রাতের মেনুলিস্ট। বিট্টু আর দীপ্তি
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রোজের মত বাই করতে লাগল। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় যতক্ষণ দেখা
যায় আমিও হাত নেড়ে বাই করলাম।
*****
অফিসে পৌঁছে কিছুতেই মন বসছে না কাজে। দীপ্তিকে ফোন
করলাম। দীপ্তি বিট্টুকে খাওনোয় ব্যস্ত থাকায় ইতস্তত ফোনে রাতের মেনুর কয়েকটা কথা
সেরে নিলাম চটজলদি। থেকে থেকেই একটা হালকা চিন্তা পিনপিন করছে মাথায়। ‘বাবু’ আজই কেন দেখা করতে চায়? আগামীকালই তো শনিবার। উইক এন্ডে আসতে পারত চাইলে। সারাদিন জমিয়ে আড্ডা
মারা যেত। তবে কি কোন জরুরী দরকার হয়ে পড়ল? এই সব সাতপাঁচ
ভাবনারা বিঁধতে লাগল মনের ভিতর। এরই সাথে হাতড়ে ফিরছি পুরনো স্মৃতি। সহসা এক সুদূর
অতীত এসে দাঁড়িয়েছে চোখের সামনে। চারবছরের হোস্টেলের দিনগুলোর বেশির ভাগ সময়টাই
কাটিয়েছি বাবুর সাথে। একসাথে আড্ডা, মদ, সিগারেট আরও কত কি?
বাবুর সাথে ঘনিষ্টতা বাড়ল প্রথম সেমিস্টারের পর পর।
হোস্টেলের সরস্বতী পুজো উপলক্ষে ঘরোয়া বিচিত্রা অনুষ্ঠান। পড়াশুনার সাথে সাথে আমি
তখন টুকটাক লেখালিখি করি। সেবারে অনুষ্ঠানের জন্যে এক্কেবারে একটা আস্ত নাটক লিখে
ফেলেছি। তার পরিচালনা আর নির্দেশনার দায়িত্বও আমার ঘাড়ে। আর বাবু’র দায়িত্ব ছিল পুরো অনুষ্ঠানটা সঞ্চালনা করার।
আঠারোর বাবুর মুখখানা তখন হুবহু নায়কোচিত। পোশাকআশাক
পুরো নামকরা স্টারের আদল। স্যুটেড-বুটেড উইদ জোডিয়াক টাই। বাবুর ঠাটবাট আর
সাজগোজের বাহার সারা হোস্টেলের আর কারোরই ছিল না। ঘরে ঢুকলে মনে হত আস্ত একটা
পার্লার। কত রকমের কসমেটিক স্নো-পাউডার-ক্রিম। কেবল মাত্র এই একটি ঘরের দেওয়ালেই
ছিল নিজে থেকে লাগানো লম্বা চওড়া আয়না। স্নান করে উঠে বাবু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে
ভিজে চুলে লাগাত জেল। তারপর উল্টো করে ব্রাশ করে চুল আঁচড়াত। মাথার মাঝখানে বেশ
মানানসই স্পাইক ছিল। যতদূর শুনেছি বাবুর বাবা ছিলেন ডি.এস.পি নর্থ চব্বিশ পরগণা। একমাত্র ছেলে। তাই তার ঠাটবাট মুনশিয়ানায় ভরা।
সেবারে সেই অনুষ্ঠানের সূত্র ধরেই বাবুর সাথে ঘনিষ্টতা।
রিহার্সাল চলাকালিন ঘনঘন সিগারেটে ফুঁ মারত বাবু। আর অবধারিত লাস্ট কাউন্টারটুকু
জুটতো আমার। এইভাবেই বাবুর সাথে বন্ধুত্বটা বেড়ে গেল।
শুরুটা ভাল হলেও হোস্টেলে বাবুর শেষটা ঠিক ভাল ছিল না।
পর পর দু’বছর বাবুর সঞ্চালনা হোস্টেলের বাকী কারোরই পছন্দ হল না কেবল আমি ছাড়া।
সেটা হয়ত আমার অতিশয় বন্ধুপ্রীতি। বাকীদের যুক্তি, বাবুর
ইংরাজি উচ্চারণ নাকি যাচ্ছেতাই। কথাবার্তার ঢং এক্কেবারে অখাদ্য, পাতে নেওয়ার মতন নয়। তাই হোস্টেলের পুনর্মিলন অনুষ্ঠানের সঞ্চালনার
দায়িত্ব আর ওকে দেওয়া চলবে না। বাবুর অত্যন্ত মন খারাপ হয়ে গেল। রিহার্সালের
দিনগুলো বিষ দাঁত ভাঙ্গা সাপের মতই অস্থির মনে হত ওকে। কেবল আমার ঘরে চলে আসত ছটফট
করতে করতে। তারপর দীর্ঘক্ষণ গট হয়ে বসে থাকত। চোখে মুখে ব্যর্থতার এক আকাশ ছায়া।
আমি ওকে খুশি করার জন্যে বলতাম কতরকমের গালভরা কথা!
- দেখ
না এবারে কেমন ছড়ায়? তখন তুই বেশ করে বলতে পারবি।
- বাবু
চুপচাপ। মুখ দিয়ে কোন কথা সরে না। শুধু চোখটা জুলজুল করে। চিনচিন করা ব্যথায় ওর
বুকটা টনটন করে। অস্ফুট স্বরে বলল আমি থাকছি না ওই দিন।
- কেন?
- না
রে আমি থাকতে পারব না?
- তুই
কি পালিয়ে যাচ্ছিস?
- হ্যাঁ
রে। এছাড়া আর কোন পথ নেই আমার। এটা আমার একপ্রকারের ইনসাল্ট।
- কি
বলব বুঝতে না পেরে বললাম, ঠিক আছে যেটা ভাল বুঝিস সেটাই করিস।
বাবুর চোখে এক নদী জল টলটল করতে দেখেছি সেই সময়। নিজের
অসহয়তাকে লাঘব করার জন্যে একজন সহৃদয় বন্ধুর দরকার ছিল। আর বাবু যেন লতার অবলম্বন
দণ্ডের মত আঁকড়ে ধরেছিল আমায়। আর আমিও সাহায্য করেছি কারণে অকারণে। চারবছর কাটিয়ে
কলেজ থেকে বেরিয়ে শুনেছি বাবু, ব্যাঙ্গালোর গেছে এম.বি.এ করার জন্যে। তিন বছরের কোর্স। দুবছর দেশে আর একবছর ইউ.এস.এ ইন্টার্নশীপ।
আমি তখন একটা চাকরির জন্যে ফাইট মেরে যাচ্ছি। আস্তে আস্তে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল
বাবুর সাথে। বন্ধুদের মুখে শুনেছি বিদেশ থেকে ফিরে কোন এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বড়
অফিসার হিসাবে চাকরি পেয়েছে বাবু। সেই শেষ খবর। তারপর কলেজ মোড়ে দেখা সেদিন।
[তিন]
অফিস থেকে বাড়ি পৌঁছালাম সন্ধ্যের ঠিক একটু পরেই।
হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় বসলাম বেতের আরাম চেয়ারে। পাশে বেঁটে টুলে রাখা
ধূমায়িত চা। প্লেটে রাখা খড়খড়ে টালি বিস্কুট। সিগারেটের প্যাকেট আর সেকেলে
অ্যাশট্রে। চায়ে চুমুকের সাথে সাথেই সিগারেটের নেশাটা চড়ে বসল। একটা সিগারেট ধরিয়ে
সুখটান দিতে দিতে ভেসে উঠল বাবুর মুখ খানা। পনেরো বছর আগে ফেলে আসা বন্ধুর সাবেকি
মুখখানা। যদিও সেদিন জীর্ণ কঙ্কালসার মুখটা দেখছি কলেজ মোড়ে। তবুও সে চিত্র যেন
ক্ষণিকের টেলিশট। বারে বারে ফিরে আসছে যৌবনের সেই সতেজ সবুজ দিনগুলোর কথা।
বর্ষা কেটে গিয়ে এখন শরৎকাল। তাই আশ্বিনের হালকা বাতাসে
গা’টা শিনশিন করে যাচ্ছে। পুজো যদিও একমাস পর এখন থেকেই আকাশ বাতাস পুজোর
গন্ধে ম ম করছে চারিদিক। আর এইরকমই একটা মিলন সময়ের আগে পুরনো ছেঁড়া সম্পর্কের
সুতোটা আবার জোড়া লাগবে। তাই থেকে থেকেই মনটা চিরিক দিয়ে উঠছে। বাইরের আকাশটার
দিকে চেয়ে একমনে অপেক্ষা করতে লাগলাম বাবুর পথ চেয়ে।
কলিংবেলের আওয়াজে বিট্টু ছুটে গিয়ে দরজা খুললো। তারপর
এক দৌড়ে এসে মাকে বলল,
- দেখ
কে এসেছে?
- উত্তেজনা
সামলাতে না পেরে আমিও জিজ্ঞাসা করলাম, কে রে বিট্টু?
- একজন
আঙ্কেল।
- এবারে
উঠে এলাম চেয়ার ছেড়ে।
- অহ!
বিনয় দা। বলুন কি খবর?
- খবর
কি আর?
চলে যাচ্ছে আপনাদের দয়াতে।
- ধুর
কি যে বলেন? তা কি মনে করে?
- যদি
পেপারের বিলটা দেন?
- নিশ্চয়ই।
ভেতরে আসুন।
- না
থাক। তাড়া আছে।
বিল মিটিয়ে ঘরে ঢুকলাম। মোবাইলটা বেজে উঠল তখনি।
ডিসপ্লেতে দেখাছে ‘বাবু ইজ কলিং’।
- হ্যালো।
বল কোথায়?
- এই
তোর বাড়ির সামনে। সিকিউরেটি জিজ্ঞাসা করছে কোথায় যাব?
- তুই
একবার ফোনটা দে।
- হ্যালো
কওন?
- হরি
সাহাব।
- শোনো
না। জো বান্দা উধার খাড়া হ্যায় উস্কো ভেজ দো উপর। ওহ মেরা দোস্থ হ্যায়।
- ঠিক
হ্যায় সাহাব। অভি ভেজ রহা হু।
কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুললাম। বেশ উস্কো খুসকো
দেখাচ্ছে বাবুকে। ভিতরে ঢুকে বসল সোফার উপর।
তারপর একরাশ ক্লান্তি মাখা শরীর এলিয়ে দিল। আমি আরেকটি সিঙ্গল সীটার সোফা টেনে
নিয়ে বসলাম মুখোমুখি। মুখ ফুটে বলার আগেই বাবু বলল,
- এক
কাপ চা চাই। ভীষণ মাথা ধরেছে!
- চা
না কফি?
- না
রে আমার এক কাপ দুধ চা হলেই চলবে। কফি আমার ধাতে সয় না।
- সে
কীরে?
তুই তো এককালে কফি খেতেই ভালোবাসতি?
- তা
হয়ত। মানুষের চিরকাল তো ভালোবাসা একই জিনিসের উপরে থাকে না। সময় আর অবস্থার
প্রেক্ষিতে পরিবর্তিত হতে থাকে ভালোবাসার ইচ্ছাটা।
- মাথা
নেড়ে বললাম একদম ঠিক বলেছিস। আমারও তো অনেক ভালোলাগা এখন পরিবর্তিত হয়ে গেছে।
দীপ্তি আর বিট্টু এরই মধ্যে এসে পরিচয় করে গেছে।
কিছুক্ষণ পর দীপ্তি বেশ কড়া করে বানানো গাঢ় দুধের চা নিয়ে এলো। চায়ে চুমুক মারতে
মারতে কথা চলতে লাগল।
- তারপরে
কাকু কাকিমা কেমন আছে?
- ওনারা
ভালই আছে।
- কাকুর
কি এখনো চাকরি আছে?
- না
রে রিটায়ার্ড করেছে দু’বছর হল।
- আর
তোর খবর বল। কেমন আছিস?
- ওই
যে বললাম বেঁচেবর্তে আছি। তারপরে ঢোক গিলে বাবু বেশ চুপচাপ। ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ছে।
- কি
হল?
- আমার
চাকরিটা আর নেই রে এখন।
- সে
কী?
- রিসেশন।
একসাথে উপর লেভেলের অনেকজনকে ছাঁটাই করেছে। তাই বিপদে পড়ে গেছি।
- অন্য
কোথাও চেষ্টা-চরিত্র করিস নি?
- ব্যাঙ্কের
অবস্থা খুব খারাপ। আমার কোয়ালিফিকেশন অনুযায়ী কোন চাকরি বেরচ্ছে না। যদি অন্য কোন
পোস্টে অ্যাপ্লাই করি তাহলে ওরা বেশি যোগ্যতার জন্যে আমার সিভিটা ওরা বাতিল করছে।
- বাবুর
মুখটা এই অবস্থায় শুকনো খেজুরের মত। জিভটা শুকিয়ে গেছে। জলের বোতলটা এগিয়ে দিলাম
ওর দিকে। তারপর বললাম, তাহলে কি ভাবছিস এখন? একটা কিছু তো করতেই হবে।
- আমাকে
একটু মানিটারি হেল্প করবি? বাবা সৎ পুলিশ অফিসার থাকার জন্যে
কিছুই টাকা সংগ্রহ করতে পারেন নি। যতটুকু ছিল আমাকে এম.বি.এ
পড়ানোর জন্যে ব্যয় হয়ে গেছে। আবার একটু ঘুরে দাঁড়ালে শোধ করে দেব।
- কত
লাগবে তোর?
- হাজার
পঁচিশের মতো।
- এতটা
একসাথে হয়ত মুশকিল। কাল অ্যাকাউন্টটা চেক করে তোকে বলতে পারব কতটা দিতে পারব।
- ঠিক
আছে বন্ধু। কালই জানাস।
এরপর ডিনার সেরে বাবু চলে গেল বাড়ি। দীপ্তির সাথে কথা
বললাম বাবুর দুর্দিনের কথা নিয়ে। হঠাৎ দীপ্তির মুখটা খানিকটা পাংশুটে মনে হল। হয়তো
বন্ধুকে এতগুলো টাকা দিয়ে সাহায্য করব তাই ভেবে। ইতস্তত করতে করতে দীপ্তি বলল,
- শোন
না এতগুলো টাকা একসঙ্গে চাইছে। ওর রুমমেট কি যেন নাম?
- প্যাংলা।
- হ্যাঁ।
ওকে একবার কল করে জানই না। নিশ্চয় ওর কাছেও জানাবে বিপদের কথা।
- তুমি
না দীপ্তি! তুমি কি বাবুকে সন্দেহ করছো?
- না
সেরকম নয়। তবুও একবার জিজ্ঞাসা করই না।
দীপ্তির অতিশয় পিড়াপীড়িতে প্যাংলাকে কল লাগালাম। তারপর
যা শুনলাম তা খানিকটা অস্বস্তির মাত্রা
বাড়িয়ে দিল আমার।
- হ্যালো
প্যাংলা।
- কে?
- ঋদ্ধি
বলছি রে।
- বল।
অ্যাদ্দিন পর কি মনে করে?
- আজ
বাবু এসেছিল আমার ঘরে।
- টাকা
চেয়েছে?
- হ্যাঁ।
তুই জানলি কি করে?
- একদম
দিস না। হি ইজ অ্যা লায়ার। ব্যাটা ব্যাঙ্কে বড়সড় পদে চাকুরীরত ছিল। অতিরিক্ত লোভে
চাকরি দেবার নাম করে লোকজনের কাছ থেকে টাকা তুলেছে। চাকরি দেবার ক্ষমতাও ছিল ওর
হাতে। কিন্তু এই কাজটা রেখে ঢেকে করতে পারে নি। সি.বি.আই রেডহ্যান্ডে গ্রেপ্তার
করেছে ওকে। এরপরে ওর চাকরি গেছে। এরপর সবার কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে রিশেশনের কথা
বলে। কাউকে ফেরৎ দিচ্ছে না। আমার কাছ থেকেও দশ হাজার নিয়েছে পাঁচ মাস আগে।
- থ্যাংকস
প্যাংলা। তুই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিস।
- কত
চেয়েছিল?
- পঁচিশ
হাজার।
- কিছু
একটা বলে কাটিয়ে দে। একদম দিস না।
সে রাত্রে আর কিছুতেই চোখের পাতা এক করতে পারিনি।
সীমাহীন লোভই মানুষকে ফেলে দেয় পতনের মুখে। এই পতনের শব্দ নিরুচ্চার। এই মূক
শব্দের ধ্বনি আশেপাশের মানুষ জানতে পারে তার তার হাবভাবে। দীপ্তির হয়ত এই কারণেই
খটকা লেগেছিল।
পরের দিন ফোন এলেই ইনিয়ে বিনিয়ে মিথ্যা কথা বললাম। আমার
এক আত্মীয়ের সেরিব্রাল হয়েছে গত রাতে। তুই যাবার পরই খবরটা পেলাম। ওদেরকে বেশ কিছু
টাকা দিতে হবে রে। তাই তোকে এই যাত্রায় আর সাহায্য করতে পারলাম না। ফোনের ওপার
থেকে নিঃশব্দ আওয়াজ ভেসে আসছে। এযেন ঘনঘন শ্বাস ওঠা পড়ার আওয়াজ। ভাল থাকিস বলেই
একরাশ অভিমান নিয়ে ফোন কেটে দিল কটাং করে।
[চার]
বাবুকে ওই ভাবে না করার পর থেকেই কেমন যেন একটা
ধর্মসংকটে ভুগছিলাম। একটা মানুষ ভরসা করেছিল তার বন্ধুকে। তার আশার আগুনে জল
ঢেলেছি। কতটা মর্মাহত হয়েছে সে! শুধুমাত্র প্যাংলার মুখ থেকে সত্যতা যাচাই করেই না
করেছি ওকে। প্যাংলা ওর রুমমেট। পুরনো শত্রুতার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যেই হয়তো বলেছে।
মনের ভিতর একটা খচখচ করে কাঁটা বিঁধছিল সব সময়।
বাবুকেও বেশ কয়েকদিন ধরে ফোনে ট্রাই করে পেলাম না। মনে
মনে কষ্ট পেতে লাগলাম। আমি সত্যিই একজনের সাথে তার অসহয়তার সময়ে চিট করলাম। অনেক
ভেবে স্থির করলাম ওর বসিরহাটের গ্রামের বাড়িতে একবার গিয়ে দেখে আসি কি অবস্থা? বুকশেলফের মধ্যে ধুলো ধরা পুরনো একটা ডায়েরি বের করলাম। হস্টেল ছাড়ার আগে
সবার কাছ থেকে পাওয়া শুভেচ্ছা বার্তা আর বাড়ির ঠিকানা লেখা ছিল তাতে। দীপ্তিকে
বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠিক করলাম কাল সকালেই যাব ওর বাড়ি। আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে
দীপ্তিও রাজি হয়ে গেল।
পরের দিন সকালে আমরা রওনা হলাম বসিরহাটের দিকে।
বাংলাদেশের শেষ সীমানায় এক প্রত্যন্ত গ্রামে ইছামতী নদীর তীরে ওদের বাড়ি। সড়ক পথ
থেকে গ্রামে পৌঁছানোর যানবাহন বলতে সাইকেল, ভ্যান, রিক্সা। আমরা কাঁচা রাস্তার অনেকটা পথ ভ্যানরিক্সায় গেলাম। তারপর সরু আলপথে
যেখানে আর ভ্যানও ঢোকে না খালি পায়ে হেঁটে চললাম অগত্যা। দিগন্ত বিস্তৃত ধূ ধূ
শূন্য মাঠ আর মাঠ। মধ্যাহ্ন রৌদ্রের স্তব্ধতা ঝাঁ ঝাঁ করে। মাথার উপর ঠিকরে পড়ছে
গনগনে আগুনে তাপ।
এই রাস্তার দীর্ঘ খাঁ খাঁ শূন্যপথ কাটিয়ে অবশেষে জনবসতি
এলাকায় ঢুকতে চলেছি। এবারে খোলা মাঠের মাঝে মাঝে সোনালি ধানের চারা চোখে পড়ছে।
হাওয়ায় হাওয়ায় দুলছে ধানের শিষ। ধুলো ধরা রাস্তায় কুকুর, হাঁস, মুরগির ছড়াছড়ি। বহুকাল এই রকম গ্রাম্য পরিবেশে
আসা হয়নি।
রাস্তায় দুই একজনকে জিজ্ঞাসা করাই এখানে ডি.এস.পি
সাহেবের বাড়ি কোথায় বলায় ঠিক ঠাক রাস্তা বলে দিয়েছে। অবশেষে খুঁজে পেলাম পুলিশ
অফিসারের বাড়ি। কলিং বেল বাজানোর পর একজন বৃদ্ধ লোক বেরিয়ে এলেন। পরিচয় দেওয়ার পর
আমাদের গেটের ওপার থেকেই বললেন একসময় শুভঙ্করের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল। এখন
অনেকদিন হল সমস্ত সম্পর্ক কাটছাঁট হয়ে গেছে। যদি বেশি কিছু দরকার থাকে, তাহলে পাশের গ্রামেই ওর রিলেটিভ থাকে সেখানে চাইলে আপনারা দেখা করতে
পারেন।
মনে মনে ভীষণ রাগ হল। ছেলের সাথে রাগ হতেই পারে। তাই
বলে এতদূর থেকে আমরা এসেছি একবার বসতে অবধি বলল না। ওখান থেকেই ফিরে আসতে চাইলাম।
শুধু মাত্র দীপ্তির অনুরোধে আমরা পাশের গ্রামে বাবুর রিলেটিভ এর সাথে দেখা করতে
গেলাম।
আরও খানিকটা পথ হেঁটে আমরা পৌছালাম এক্কেবারে ইছামতীর
পারে। মাটির বাড়ি। খড়ের ছাওনি দেওয়া ঘর। উঠোনের মধ্যে দিয়ে গিয়ে কলতলা থেকে ডাক
দিলাম,
- বাড়িতে
কেউ আছেন?
- মিনিট
খানেক সাড়াশব্দ নেই। তারপর কালচিটে দরজা খুলে এক বৃদ্ধলোক আর মহিলা বেরিয়ে এলো।
চোখে মনে হয় ছানি পড়ে গেছে। মুখে অসংখ্য বলিরেখা। কলজের সবকটি কঙ্কাল গোনা যায়।
আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন আপনারা কারা?
- আচ্ছা
এটা কি শুভঙ্কর সেনের আত্মীয় বাড়ি?
- আজ্ঞে
হ্যাঁ। আমি ওর বাবা।
- মানে? তাহলে ওই পুলিশ অফিসার?
- মিঃ
দত্ত। পাশের গ্রামে থাকে। আপনারা ওনার কথা বলছেন কি?
- টাইটেলটা
বলতে পারব না। তবে ওনার কথায় বলছি।
- উনি
শুভঙ্করের বাগদত্তার বাবা। মানে হবু শ্বশুর। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ থাকায়, ওর পড়াশুনার যাবতীয় দায়িত্ব নিয়েছিলেন উনি।
- তাহলে
বিয়েটা হল না কেন?
- থুত্থুড়ে
গলায় বৃদ্ধটি বললেন মেয়েটি। আমার ছেলের প্রতি ওর অযাচিত অতিরিক্ত আশা ছিল। বাড়ি, গাড়ি তাড়াতাড়ি করতে পারছে না কেন? সেই নিয়ে খুব কথা
কাটাকাটি হত মাঝে মাঝেই। ছেলেটা বাড়িতে এসে দু’মুঠো খেতে
পারত না ভালোমত। সেই কারণেই অসৎ পথে ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়ে ওর চাকরিটা গেল। আমাদের
সব শেষ। আমরা জ্বলে পুড়ে মরছি।
- আর
মেয়েটি?
- মেয়েটি
ওকে ল্যাং মেরেছে। ওর দুর্দিনে পাশ থেকে সরে পড়েছে। অথচ মেয়েটিই উসকানি দিয়েছে এই
অপরাধ করার জন্যে।
আর কথা বাড়াই নি সেদিন। সারা রাস্তা আমরা বেশ চুপচাপ
চিলাম দুজনে। থেকে থেকেই একটা খোঁচা মারা প্রশ্ন উঠছিল মনে, এই সাহায্যটা করাটা কি উচিৎ ছিল আমার? আবার ভাবছি
বাবু সবাইকে ঠকিয়েছে। নিজের বাবা, মা, হবু
বাগদত্তা, তার পরিবার, হোস্টেলের
বন্ধুবান্ধব সবাইকে। তাই ওর এইরকমটিই হবার ছিল। পরক্ষণেই আবার ভাবছি একসময়ে সুখের
বসন্তে ওর সাথেই তো কেটেছে সবচেয়ে বেশি সময়। বাবু আমার বন্ধু। একটা সুতোর মত আটকে
থাকে এই বন্ধন। এটা এত সহজে ছিন্ন করলে কি চলে?
[সমাপ্ত]
0 comments:
Post a Comment