Thursday, December 25, 2014

প্রচ্ছদ কথা

শীত উৎসব
প বি ত্র  আ চা র্য্য

এই বড়দিনে এক-সময় হেঁটেছি মেলবোর্নের রাস্তায়। জন-শূন্য, যানজট-হীন স্তব্ধ দিবস। কোন আলাদা আলো নেই। মাইকে সুর-সঙ্গীত নেই। কেমন যেন একটা ম্যাড়া ভাব সর্বত্র

শী এসে জাঁকিয়ে বসেছে ঘরের ভিতর। কুয়াশায় মুড়ে গেছে শহরের রাস্তাঘাট। হিমেল হাওয়ায় জবুথবু হয়ে গেছে জনজীবন। বছরের এই কয়েকটা দিন লেপের ভিতর ওম খুঁজে ফেরা। অলস সকাল কাটিয়ে, দিনের শুরু যেন স্লো-মোশনে ধিক ধিক। ক্রমে রহস্যময়ী কুয়াশা সরে যায় চোখের সামনে থেকে। দৌড়াতে থাকে মানুষ ঘড়ির নিয়মে। যার যার নিত্য কাজের ফাঁকে উঁকি দেয় বর্ণীল উৎসব। বাংলার শহর, গ্রামগঞ্জ, বাংলার আনাচ কানাচ জুড়ে উৎসবের অনাবিল ঘনঘটা। শীতের বর্ণময় বৈচিত্র্যতার সাথে একীভূত হয়ে পড়ে উৎসবমুখর বাঙালি।

এই দেশ জুড়ে নানা ধর্মের নানা বর্ণের মানুষ বাস করেন। ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’। কোন উৎসবই আজ কোন ধর্মের ব্যক্তিগত উপচর্যা নয়। স্থান কাল শহর-গ্রামগঞ্জ মফস্বল সর্বত্র হাত ধরাধরি করে মানুষ মেতে ওঠে পার্বণে। বিশেষ ধর্মীয় রীতিনীতি, ব্যক্তিগত রেওয়াজ ও লোকাচারের গণ্ডী ছিন্ন করে এই দেশের মানুষ মানবধর্মকে মূলত একটি ধর্ম ভাবতে জেনেছে। লৌকিকতার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় সবাইকে আপন করে নিতে শিখেছে। 

শীতের সময়ে বাঙালির উঠোন জুড়ে সোনার ফসলের মেলা লেগে থাকে। তাকে আরও হৃদয়গ্রাহী করার জন্যে আমরা মেতে উঠি ‘নবান্নে’। গ্রামেগঞ্জে ভিড় লেগে যায় ‘গাছি’ দের। খেজুরের ছাল তুলে সেখানে বাঁশের নল ঢুকিয়ে কলসি ভরা হয় গাছের রসে। এই মায়াবী সঞ্চার আর আর তার মন্ত্রমুখরতা থেকে একটি কেউ সরিয়ে নিতে পারে না নিজেকে। 

মাঠ-মাঠ ভরা পিঙ্গল বর্ণের সর্ষে ফুল। এক অদ্ভুত মোহময় গন্ধ! এই রূপের সাথে পাল্লা দিয়ে গরমের পোশাক পরা। রঙ-বেরঙের শীত-চাদর, সোয়েটার আর জ্যাকেট। যেন পাল্লা দিয়ে ছুটছে সবাই। হৃদয়ের জানলা ধরে উঁকি দেওয়া কত বিচিত্র রঙের মেলায় ভেসে যায় চোখ। লাউয়ের ডগায় ভোরের শিশির, তার উপর খেলে যাওয়া সূর্যরশ্মি। ঝিলিক দিয়ে ওঠে সহস্র হীরককণা। ঢুলুঢুলু ঘুম ভুলে চোখের পাপড়ি খুলে বাইরের দিকটা দেখি। মাচায়-মাচায় সবুজ সবজি। কৃষকের আঙিনা জুড়ে দেমাকি চেহারা তার। গুণ গুণ গানে ভরে ওঠে ফুলের ভুবন। মো-মাছি, বাহারি ডানার প্রজাপতি খুঁজে ফেরে মধু। কত পরিযায়ী পাখিদের মেলা পুরো শীত জুড়ে। 

এরই মধ্যে এসে যায় ‘বড়দিন’। এই পবিত্র ক্রিসমাস জুড়ে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র মানুষ মেতে থাকে উৎসবে। বিশ্বজুড়ে অগণন মানুষ ঈশ্বরপুত্রের মানবিক আবির্ভাব এবং তার অবিস্মরণীয় তিতিক্ষার অনুপম বেদিমূলে শ্রদ্ধাবনত। বাঙালি এই দিনটাতে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয় সবার সাথে। এত নিবিড় বন্ধনে নিজেদের বেঁধে নিই আমরা, যেন সকলেই প্রভু যীশুর সন্তান। এখানে দেশজ আঞ্চলিক ও লোকসংস্কৃতির মহামিলনের ফলে বড়দিন উৎযাপনে নানা বৈচিত্র্য চোখে পড়ে। আঙ্গুলে আঙ্গুলে লেগে থাকে মিলনের স্বাদ।



উৎসবে বাঙালি পৃথিবীর অন্যতর যেকোনও প্রান্তের থেকে ভিন্ন। যেকোনো উৎসবকে ঘরের হিসাবে মেনে নিয়েছে। এই বড়দিনে এক-সময় হেঁটেছি মেলবোর্নের রাস্তায়। জন-শূন্য, যানজট-হীন স্তব্ধ দিবস। কোন আলাদা আলো নেই। মাইকে সুর-সঙ্গীত নেই। কেমন যেন একটা ম্যাড়া ভাব সর্বত্র।
অথচ আমার শহর জুড়ে থোকা থোকা মানুষের বিজবিজে ভিড়। রাস্তায় রাস্তায় ঝলসানো আলোক-মালা। বেজে ওঠা মনের ছন্দ তার সাথে মায়াবী ট্র্যাক! এই উৎসব মুখরতা পৃথিবীতে আর কোথায় এতটা দেখা যায়? যেখানে বাঙালি, সেখানেই উৎসবের সজীবতা। ট্যারেন্টুলা পোকার সজীব তরতরে ভাবখানা শুধু গেঁথে থাকে বাঙালি মননশীলতায়। 

অনেক দেশেই বড়দিন বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে উপহার আদানপ্রদানের মরসুম। বড়দিন ও উপহার আদানপ্রদানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একাধিক খ্রিষ্টীয় ও পৌরাণিক চরিত্রের উদ্ভবের সঙ্গেও বড়দিন উৎসব অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। বড়দিনের আগের দিনের সন্ধ্যায় লালটুপির বুড়োর কথা আমরা কে না জানি? আমাদের আবাল্য জুড়ে রয়ে গেছে খেলনা বুড়োর কত স্মৃতি। হো হো হো – মেরি ক্রিসমাস এই শব্দে উপহারের ডালনা বোঝাই করে ছুটে আসছেন তিনি। তার মায়াবী জাদুতে বাচ্চারা খিল খিল করে হসে ওঠে। সান্টা একলহমায় সমস্ত শিশুমন জুড়ে বিস্তার করে নেয় তার সাম্রাজ্য। 

এতসব ভাল-বন্দনার মাঝেও যে ছিট-ছাট গন্ধ লেগে থাকে, তা লুম্পেন-রাজের দৌলতে। মানুষ অথচ পৈশাচিক শক্তির দৌরাত্মে। যেকোনো মানবিক চিন্তার বাইরে আরেকটি ধ্বংসাত্মক তালিবানী মনোভাব লুকিয়ে থাকে গলিঘুচিতে। ওর নির্মম। নিষ্ঠুর। নারকীয় হত্যার ন্যক্কারজনক ঘটনায় ওর মেতে ওঠে উল্লাসে। মৃত্যুতে মোক্ষলাভ হয় না কোন ভাবেই। কিছুতেই ধর্মের অন্ধগলি থেকে মুক্তির পথ পাওয়া যায় না। এই সত্যটুকু বিলিয়ে দেওয়ার ভার নিক সান্টা। যাতে করে মানব শিশুর মন-জুড়ে মানবিকতার ফুল ফুটে ওঠে সমস্ত ঋতু জুড়ে। এটাই সমস্ত দর্শনের মূল কথা হয়ে উঠুক। ধ্বংসের বেদীতে শান্তির ফুল পত্তন করে বহমান জীবনের কাছে মূল্যবোধের সারমর্মটুকু পৌঁছে দাও সান্টা। এটাই বড়দিনে বিশ্ববাসীর আপন উপহার।


0 comments:

Post a Comment