অচেনা সুন্দরীর ট্র্যাজিক ম্যাজিক
ই ন্দি রা মু খো পা ধ্যা য়


সবুজ এখানে প্রচুর কিন্তু শাকাহারী জন্তুদের খাবার মত ঘাসপাতা এখানে কম তাই এখানে মানুষ হল বাঘের সহজলভ্য শিকার। চিতল হরিণ আছে তবে তার খাদ্যের প্রাচুর্য নেই ফলে খাদ্য শৃঙ্খলের অনেকটাই বিপন্ন। এতসব শুনতে শুনতে বেলা পড়ে এল, এবার লাঞ্চ @ লঞ্চ।

ই ন্দি রা মু খো পা ধ্যা য়
“এখানকার মানুষের দৈনন্দীন জীবন জোয়ারভাঁটার
টানাপোড়েনে অতিবাহিত হয়। ম্যানগ্রোভ অরণ্যের মত সয়ে গেছে এদের জীবনযাত্রার খুঁটিনাটি।
এরা জঙ্গল বোঝে, পশুপাখি বোঝে তবুও প্রকৃতি রুষ্ট হলে এরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”
নামটায় যতটা
সৌন্দর্য্য ঠিক ততটাই সুন্দর তার ভৌগোলিক চেহারা। আর সেখানে মানুষের প্রতিনিয়ত
জীবনসংগ্রামও ঠিক ততটাই ভয়ানক। সেখানে ডাঙায় বাঘ আর জলে কুমীর নিয়ে যে মানুষেরা
অহোরাত্র বেঁচে থাকে ভৌগোলিক সৌন্দর্য্য তারিয়ে খাওয়া তাদের ভাগ্যে নেই। এই হল
পশ্চিমবাংলার বদ্বীপ অঞ্চল সুন্দরবন যার সাথে জড়িয়ে আছে কিংবদন্তীর কড়চা। বেহুলা
ভেলা ভেসে এসেছিল যার নেতিধোপানির ঘাটে। এই সেই সুন্দরবন যার প্রেক্ষাপটে রচিত
হয়্রেছে অমিতাভ
ঘোষের হাংরি টাইড অথবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি। এখানে চরাচর জুড়ে
আছে নোনাজলের ঐশ্বর্য্য যার অনন্ত, অসীম জলরাশির মাঝে লুকিয়ে
থাকে অগণিত সজীব আর সবুজ। গল্পকারের ভাষায় যা হয়ে ওঠে মূর্ত, ভ্রমণপিপাসুর কলমে যা হয়ে ওঠে আরো প্রাণবন্ত। কালের স্রোতে যার ভূগোল
পুরণো হয়না সেই বায়োডাইভার্সিটির অন্যতম নিদর্শন সুন্দরবনে হাজির হলাম আমরা ক'জন। শীতের আলসেমি আর ভোরের রোদ্দুরকে সঙ্গী করে কলকাতা থেকে গাড়ি করে
ক্যানিং পেরিয়েই মাত্র
একশো কিলোমিটার দূরে গদখালি। কলকাতার কাছেই এমন অনবদ্য উইকএন্ড স্পট এখনো অনেক
বাঙালীর না-দেখা । ইউনেসকো
ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমা নিয়ে স্বমহিমায় বিরাজ করছে এই ম্যানগ্রোভ অরণ্য। এবার
গাড়িকে দুরাতের মত গদখালির বিশ্বস্ত খোঁয়াড়ে পার্ক করে মালপত্র নিয়ে লঞ্চে উঠে পড়া
সকলে মিলে। কলকাতার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমরা ছিলাম মোট বাইশ জন।
চুলোয়
গেল ঝুটঝামেলি, শিকেয় তোলা কূটকাচালি।
বন্দী
হলাম লঞ্চে ভেসে, সুন্দর বন চারিপাশে ।
বিদ্যেধরীর
বিস্তৃত পাড়ে লঞ্চ ছিল বাঁধা। একে একে তার মধ্যে আমাদের সাথে উঠল দু-তিনদিনের রসদ।
কাতলা,
ভেটকি,পার্শে, পমফ্রেট,
চিংড়ি আর মুরগী। সাথে পানীয় জল যার বড় অভাব এই সুন্দরবনে। বিদ্যেধরীর এপারে
আমরা আর অন্যপারে দক্ষিণের ব্যস্ততম বাজার শহর গোসাবা। সেখানথেকেও উঠবে কিছু
আনাজপাতি। ছোট ছোট নদী দুর্গা দুয়ানী, হোগল, সূর্যভেরী,দত্তা, রায়মঙ্গল,
ঠাকুরাণ, গোসাবা সকলের আঁকাবাঁকা
নেটওয়ার্ক চোখে পড়ল গুগলম্যাপের মধ্যে। কিছু পরেই বালি আইল্যান্ড, যেখান থেকে মিষ্টিজল আমাদের ছেড়ে চলে গেল আর শুরু হল নোনাজলের সুন্দরবন।
পুবের মিষ্টি আলো গায়ে লাগছে.. হালকা শীতের নরম ওম জড়িয়ে জায়গা নিলাম। চোখ রাখলাম
বিদ্যেধরীর বিস্তৃত জলরাশিতে। সুখ আর সুখ।
নদীর গায়ে নদী
এসে লেগেছে সুন্দরবনে আর সব নদী মিলেমিশে সে যে কি বিশালতা আর সকলের একসাথে সেই
বয়ে চলা আর অবশেষে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে গিয়ে আত্মসমর্পণ। সমুদ্রের বিছানায় লুটিয়ে
পড়েও নদীর চলার শেষ নেই। সর্পিল গতিতে বয়ে চলে মোহানার মুখে একের সাথে অন্যের সে
কি সখ্যতা! সেখানেও নদীর স্বকীয়তা বর্তমান আর ফ্লোরা আর ফনার বৈচিত্র্যময়তায় ভরপুর
সে নদীর শরীর। নদীমাতৃক বাংলার অনবদ্য ট্যুরিষ্ট স্পট সুন্দরবনের শীত ঋতু জমজমাট
হয় সপ্তাহান্তের ট্যুরিষ্ট আগমনে।
এখানকার মানুষের
দৈনন্দীন জীবন জোয়ারভাঁটার টানাপোড়েনে অতিবাহিত হয়। ম্যানগ্রোভ অরণ্যের মত সয়ে
গেছে এদের জীবনযাত্রার খুঁটিনাটি। এরা জঙ্গল বোঝে, পশুপাখি বোঝে
তবুও প্রকৃতি রুষ্ট হলে এরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছিপনৌকায় মাছ ধরতে
গিয়ে কিম্বা জঙ্গলে মধু আনতে গিয়ে এরা বাঘের পেটে যায় । সুনামী বা আয়লায় এরা
সর্বস্বান্ত হয় । তবুও ভাঙতে ভাঙতে গড়ে ওঠে নতুন হ্যাবিট্যাট।আবারো জেগে ওঠে
সুন্দরবনের ফ্লোরা(flora) ও ফনা(fauna) । যেন
আগুণপাখি আমাদের এই গর্বের সুন্দরবন। পুড়ে ছাই হয়ে গিয়ে আবার তার মধ্যে থেকে নতুন
করে জন্ম নেয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয় কাবু করে দেয় একে। কিন্তু প্রকৃতি আবারো কোলে
টেনে নেয়।
লঞ্চ বা
মোটোরাইজড নৌকা ছাড়া স্থলপথে সুন্দরবন যাবার কোনো রাস্তা নেই । আমাদের গন্তব্য হল
সজনেখালি টাইগার রিসার্ভ অঞ্চল। লঞ্চযাত্রার শুরুতেই কচি ডাবের জল
দিয়ে ওয়েলকাম পর্ব সেরে নিলেন আমাদের ট্যুর অপারেটর । তারপরেই হাতে এল শালপাতার
বাটিতে করে আলুকাবলি। কখনো চোখ রাখি বিস্তৃত জলরাশিতে আর কখনো বা দুপাশের ঘন
ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ঘন সবুজে। আর গল্প শুনি বাংলার গর্বের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের।
প্রায় এগারোহাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এই টাইগার রিসার্ভ ফরেষ্ট। জলের কুমীর ঐ
বাঘের ভয়ে কাঁটা। এখানে বাঘ নদী পেরোয় নির্বিবাদে।জলের মধ্যে অবিশ্যি কামটের কামড়
তাকে খেতে হয় কখনো। এই
বাঘ ছিপনৌকায় মাছ ধরতে আসা মানুষের দল থেকে একজনকে নিঃসাড়ে টেনে নিয়ে যায়। বাকীরা
তা জানতেও পারেনা। রয়েল বেঙগল টাইগারের এত হিংস্রতার কারণ হল জঙ্গল কেটে কেটে
মানুষের বসতি গড়ে তোলা, নদীর নোনা জলের আধিক্য আর হেতাল গাছের
ভয়ানক কাঁটা। এই হেতাল ঝোপে বাঘ থাকে কিছুটা গা ঢাকা দিয়ে অথচ গুল্ম জাতীয় হেতালের
কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় তার সারা শরীর। সুন্দরীগাছের শ্বাসমূলের খোঁচায় কেটে
যায় তার পায়ের তলার নরম অংশ। সেখানে আবার নোনাজল লেগে শুরু হয় জ্বলন। তাই বাঘ
এখানে অনেকটাই বিক্ষুব্ধ ।
সবুজ এখানে প্রচুর কিন্তু শাকাহারী জন্তুদের খাবার মত ঘাসপাতা এখানে কম তাই এখানে মানুষ হল বাঘের সহজলভ্য শিকার। চিতল হরিণ আছে তবে তার খাদ্যের প্রাচুর্য নেই ফলে খাদ্য শৃঙ্খলের অনেকটাই বিপন্ন। এতসব শুনতে শুনতে বেলা পড়ে এল, এবার লাঞ্চ @ লঞ্চ।
লঞ্চ তখন মধ্যাহ্নভোজের প্রস্তুতিতে গ্যাস্ট্রোনমিক গন্ধময়তায়
ভরপুর ।
ম্যানগ্রোভ
প্রজাতির গাছগুলো যেমন দিনের পর দিন সহ্য করে জোয়ারে ধেয়ে আসা সমুদ্রের নোনা জল, ভেজা মাটি আর স্যাঁতস্যাঁতে জলহাওয়া ডাঙার মানুষেরা বেঁচে থাকে বাঘ,কুমীর আর কামটের চোখরাঙানি নিয়ে। তবুও এখানকার সূর্যোদয় কি ভীষণ সুন্দর!
আর সূর্যের পাটে যাওয়াটাও ততটাই চোখের সুখ দেয়। তবে চরাচরের সব আলোগুলো নিয়ে
পশ্চিম আকাশে যখন সূর্যাস্ত হয় তখন আকাশের লালকমলার খেলা দেখতে দেখতে
কবি-দার্শনিকরা যতটাই আপ্লুত হন স্থানীয় মানুষ আবারো অপেক্ষায় থাকে পরের সূর্যোদয়ের
।
সন্ধ্যের ঝুলে
নেমে পড়লাম লঞ্চ থেকে। জায়গার নাম দয়াপুর। সেখানেই আমাদের রাত্রিবাসের আয়োজন। রয়েল বেঙ্গল রিসার্ভ
রেসর্টে প্রবেশ করে হাত-পা-মুখ ধুয়ে ধূমায়িত চা ও গরমাগরম ভেটকি ফ্রাই খেয়ে
সারাদিনের ধকলটা যেন উড়ে গেল নিমেষে। এরপর পথের ক্লান্তি ভুলে, ভদকার শিশি খুলে আমরা পেরোলাম কিছুটা সময় .. হালকা ঠান্ডা, সুন্দরবন জমে বরফ, দই, ক্ষীর না হলেও বেশ
ভালোলাগা জড়িয়ে রইল। হোটেলের
উল্টোদিকে সজনেখালি অভয়ারণ্য। এখানে জঙ্গল যেন আরো ঘন আর হিংস্র মনে হল। অন্ধকারে
এবার নদীর ধারে বসে গল্প শোনার পালা। খলসি গাছের মধু নাকি সবচেয়ে ভালো হয়। মধু
যারা সংগ্রহ করে তাদের মউল বলে। ছিপ নৌকায় জঙ্গলে ঢুকে মউলরা হেতালের ধোঁয়া দিয়ে
মৌমাছি তাড়িয়ে চাকভাঙা মধু আনে। গ্রামগুলি খুব প্রত্যন্ত। মানুষেরাও হতদরিদ্র।
কারোর জীবিকা মধু আনা, কারোর বা ঝিনুকে করে বাগদার মীন মেপে
নোনা জলে ছেড়ে দিনান্তে কিছু পয়সা রোজগার। তবে মুখ্য ফসল হল ধান। তাই চাষবাসই মূলত
প্রধান উপজীবিকা। ডিসেম্বরের
হালকা ঠান্ডায় চোখ জুড়ে আসছিল। ডিনারের ডাক পড়ল। গরম রুটি, বেগুনভাজা,
বাঁধাকপির ডালনা আর মুরগীর মাংস খেয়ে রাতঘুম। পরদিন বেডটি কলিং।
বালতির গরমজলের দাম মিটিয়ে তৈরী হয়ে নিলাম। আবারো সাফসুতরা লঞ্চটিতে ফিরে আসা।
এসেই দেখি লুচি ভাজার পর্ব শেষ। আমাদের হাতে হাতে লুচি-আলুরদম আর চা পৌঁছে গেল।
চলতে চলতে দেখি ডাঙার চরে রোদ পোহাতে ব্যস্ত এক মাঝারি কুমীর। লঞ্চ তখন ডিজিটাল
ক্লিকে মুখর। কাছেই
নাকি সজনেখালি কুমীর প্রকল্প। কিছু পরেই সজনেখালি
নজরমিনার।আবারো লঞ্চ থেকে নামার পালা। বনবিবি ও দক্ষিণরায়ের মন্দিরে পেন্নাম
ঠুকে যেতে হয় এটাই রীতি এখানে।
জঙ্গলের রাজা
হিসেবে আদি অনন্তকাল ধরে বাঘকে মানুষ সমীহ করে। সুন্দরবনের এই ব্যাঘ্র দেবতা হলেন
দক্ষিণ রায় যাঁকে
পুজো করে মানুষ তাঁকে প্রতিনিয়ত তুষ্ট রাখে। উত্তরবঙ্গের তরাই জঙ্গলে যিনি সোনারায়
দক্ষিণবঙ্গে তিনি দক্ষিণরায়। তাঁর পুজোর সাথে সাথে বাঘের আক্রমণ থেকে
বাঁচার জন্য বনদেবী বনবিবির পুজো করে মানুষ। বাউল, মউল,
জেলে সকলে জঙ্গলে প্রবেশের আগে পুজো দেয় বনবিবির মন্দিরে। সুন্দরবনের
সংস্কৃতির সাথে এই দুইয়ের পুজো এখানকার সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে। বনবিবি
শক্তিরূপিণী মাদুর্গার আরেক রূপ। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তাঁকে এখানে স্মরণ
করে।
কত প্রজাতির গাছ
এই ম্যানগ্রোভ অরণ্যে। সব গাছেরাই প্রায় গুল্ম জাতীয় (shrub)। গরাণ
থেকে গেঁওয়া, কেওড়া থেকে হেতাল, সুন্দরী
থেকে গোলপাতা, ধুঁধুল, কাঁকরা, খাগড়া
আরো কতরকমের !
কি অপূর্ব এক
বাস্তুতন্ত্র এই সুন্দরবনের্! বিশ্বে
পরিচিত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবসস্থল রূপে তবে বাঘ দেখতে পাওয়াটা অনেকটাই ভাগ্যের
ওপর। বাঘ ছাড়াও জলের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য প্রজাতির মাছ, কাঁকড়া,
শুশুক আর চিংড়ির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। রয়েছে
গোসাপ, কচ্ছপ, টেরাপিন, গিরগিটি, ব্যাঙ, পাইথনদের মত
নানান প্রজাতির উভচরী সরীসৃপেরা । চিতল হরিণের সাথে ঘুরে বেড়ায় বুনো শুয়োর। বাঁদর
উঁকি দেয় ঝোপের আড়াল থেকে। আর গাছের ডালে চোখ রাখলেই দেখা যাবে কত ধরণের পাখি।
জলে মাছ খেতে আসে নানা প্রজাতির বক। নাকি ১৭০প্রজাতির পাখী আছে এই সুন্দরবনে। মাছরাঙা
থেকে শুরু করে কোঁচবক, সারস থেকে শুরু করে পেলিকান, জলপিপি, হেরন, জলমুরগী, ব্রাহ্মণী
চিল, পানকৌড়ি সি-গাল আরো কত কি!
ফেরার পথে
সুধন্যখালি আর পাখিরালয়। অনেক ঘোরা হল, হাঁটাহাঁটি হল বাঘের
পায়ের ছাপও দেখা গেল। কিন্তু সে যাত্রায় বাঘ আমাদের অধরা। তবে
খেচর, উভচর, জলচর আর লঞ্চের সহচরদের
সাথে ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় মন
তখন ভরপুর আর আলো-আঁধারি নিয়ে জোয়ারভাটার খেলায় মেতে তখনো সুন্দরবনের চরাচর।
হোটেলে ফিরে এসে
আদিবাসী নৃত্য আর বাউলগানে মুখর হল সন্ধ্যা আর সাথে বনফায়ার। গরম চা আর চিকেন
পকোড়াও হাজির হল মুখের সামনে। আবার পরদিনের তোড়জোড়। আরো একবার
চেষ্টাচরিত্র হল বাঘের ডেরায় উঁকি দেবার, দোবাঁকি টাইগার
প্রজেক্টে অবতরণ হল । তবুও দক্ষিণরায়ের দেখা মিললনা।
ভাবতে ভাবতে
এগিয়ে চলি লঞ্চঘাটের দিকে। নামবার পালা এবার। গোসাবায় নেমে এগিয়ে চলি রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত হ্যামিলটন সাহেবের
কুঠিবাড়ির দিকে। কিছু
ট্র্যাজিক ম্যাজিক আছে এই সুন্দরবনে যা অনায়াসে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে
এখানে টেনে আনে ।
তাই গর্ব হয় মনে মনে আবার মন ভারীও হয় এখানকার মানুষগুলোর জন্যে।
আবারো উঠবে
সুন্দরীগাছের আড়াল থেকে সুন্দর সূর্য এখানে। ভেসে যাবে সেই আলোয় সুন্দরবনের
নদ-নদী। জেগে উঠবে চর। গাছপালার সবুজ আরো আরো সবুজে ভরে উঠবে। সুন্দরবনের নোনা জল
আর মিষ্টি জলের টানাপোড়েন লেগেই থাকবে। জনসভা হবে। এখানকার স্থানীয় মানুষজনের
উন্নতির প্রতিশ্রুতিতে গর্জে উঠবে সুন্দরবনের অরণ্য। তবুও এরা থাকবে কিছুটা
ব্রাত্য, শহর থেকে আরো অনেক পিছিয়ে, অনেকটাই
প্রতিকূলতায় আর অনেকটা প্রতিবন্ধকতায় । এটাই নিয়ম।
বিদ্যেধরীর জন্য
রেখে এলাম দু'কলম চিরকূট..
দু-দুটো দুপুর
দিয়েছিলে আমায়। নিজের কোলের মধ্যে টেনে নিয়েছিলে বিদ্যেধরী । দুটো রাত রেখেছিলে
তোমার সংসারে। বিদ্যেধরী !লোভ দেখালে টাটকা মাছের্? আকৃষ্ট করলে
পাখীর ডাকে? কাছে টানলে সূর্যাস্তের রং দেখিয়ে? বিদ্যেধরী ! তোমার
কত সহ্যশক্তি! তোমার এ কূল ভাঙে আবার ও কূল গড়ে। বিনষ্ট হয় ইকোসিস্টেম। তুমি
নিঃশব্দে নীরবে বয়ে চলো এই সুন্দরবনকে আঁকড়ে ধরে।
পরক্ষণেই ভাবি, আমি যে তাকে কিছুই দিয়ে
এলামনা? বরং
নিঙড়ে নিলাম তাকে...সে আমাকে তৃপ্ত করল তার রূপ-যৌবন সবকিছু দিয়ে। তার টাটকা মাছ,
দেশী মুরগীর ডিম,খাঁটি মধু, গাছের ফলপাকড় দিয়ে...কত সাইক্লোন সামলেছে সে। সামলেছে কত বিপর্যয়। আর
আয়লা-সুনামীর সময় বুক দিয়ে আগলেছে আমাদের শহর কলকাতাকে। ফেরার
সময় লঞ্চে বসে বসে এতসব ভাবছিলাম ।
হঠাত কে যেন
ধাক্কা দিয়ে বলল, দিয়ে
যাও কিছু। লঞ্চ থেকে নেমে দেখি ক্লান্ত দুপুর সূর্যের সোনালী রোদ লেগে রয়েছে ছেঁড়া
সোয়েটার পরা ছোট একটি ছেলের চোখের তারায়। নাক দিয়ে ঝরছে অবিরত ধারা আর মুখ ফুটে
কথা নেই তার, বোবা সে। দিলাম তাকে মোটে দশটা টাকা। দশ টাকার নোট নিয়ে
তার চোখেমুখে অপার খুশির জোয়ার নামল যেন! গোসাবার লঞ্চঘাট তখন ফিরতি জনতার ভীড়ে থৈ
থৈ । আবার শুরু হল ঘরে ফেরার গান।






0 comments:
Post a Comment