বই রিভিউঃ ‘উত্তরাধিকার’ কবিতা সংকলন (নীলকণ্ঠ প্রকাশন ২০১৪)
অনির্বাণ ভট্টাচার্য
অধিকাংশই ১৯ থেকে ২৭ বছর বয়সী
নবীন কিছু কবির লেখনী দিয়ে সাজানো হয়েছে কবিতা সংকলন ‘উত্তরাধিকার’ । প্রকাশ
পেয়েছে ২০১৫ বইমেলার কিছু আগে। ২১ জন কবির প্রত্যেকের ২ টি ক’রে কবিতা দিয়ে মোট ৪২ টি কবিতার ডালি সাজানো এই বইটির
মুখবন্ধে এক নতুন সূর্যোদয়ের মতো লাল টকটকে লেখা, যা বাড়তি আকর্ষণ হতে পারে বইটির। আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রচ্ছদ নিরহঙ্কারী, সহজে বইটির ভেতরটাকে দেখিয়ে দেওয়ার মত শিল্পিত। কবিতা
চয়নের জন্য সংকলক সৌম্যদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়, ও শীর্ষ তনয়
ঘোষের প্রচেষ্টা সাধুবাদ যোগ্য। বেশ কিছু মন কাড়ানো কবিতার সঙ্গে দেখা সাক্ষাত হবে
পাতা ওলটালে। কথাগুলো কতটা মাটি ঘেঁসে
বেরোলে তবে তাকে কবিতা বলা যেতে পারে, তা জানার জন্যই বোধহয় সাদা পাতা বেয়ে কুলকুল নামে সেলিম উদ্দিন মণ্ডলের ‘চূর্ণী’ । ‘ইতিহাস থেকে আলো নিভে
গেলে/নদী পুনর্জন্ম দিতে পারে প্রেমিক যীশুর’? পড়তে পড়তে মনে হয়, আহা, যেন সবটুকু না ডোবে
চূর্ণীর জলে। সৌম্যদীপ মুখোপাধ্যায়ের দুটি কবিতাই চাবুক। হয়ত এ বইএর অন্যতম সেরা
পাওনা। ‘কুমারী পুজো’ ও ‘শিল্প এবং’ মনে হল কবি একটাতে সবটুকু বলেননি কবি, বাকিটুকুর জন্য রেখে দিয়েছিলেন। কুমারী পুজোর প্রথম দুটি স্তবকের শেষ
অন্ত্যমিল দুটোর ব্যতিক্রমী পুনারগমনকে বাদ দিলে আঙ্গিক, সাহস আর বিষয় উপস্থাপনে কবির মুন্সিয়ানা ধরা পড়ে। ‘একটা, ধর্ষিত লাল
টিপ পড়ে,
সে, দেবী সাজতে বসেছে’। সত্যি, কবি এসব না বললে কারা বলবে? অনুমিতা ঘোষ কবিতা দিয়ে পাঠককে ‘আপন’ করে নিতে পারেন। তাই, ‘দেরি হবে’ বারবার বিভিন্ন দ্যোতনায় তাঁর লেখায় ফিরে আসে, ‘দেরি শুধু পথেই মা/শিগগির তোমার কোলে পৌঁছে যাব’। মায়ের প্রতি
নিবিড় টানের দিক দিয়ে দেখলে সহজ হয়ে যাবে, মনে হল, একটা অক্ষরের জন্য
অনুমিতাদের কলম যখন বারবার হোঁচট খায়, আর আচমকা একদিন যখন পেয়ে যায় ঠিক ঠিক বুনন, আমি নিশ্চিত, এরকমই কিছু
একটা মনে হয়, ‘দেরি
শুধু পথেই মা/......’। জয়াশিষ ঘোষ একটু হিসেব ক’রে শুরু করেন। আস্তে আস্তে খোলস ছেড়ে কাহিনীতে ঢোকেন।
কবিতায় একটা আখ্যান তৈরি করেন। সে ‘সায়রা বানু’-র মতো লিরিকাল হতে পারে, বা ‘সিরিয়াল
কিলার’-এর মতো
চাঁচাছোলা গদ্যকবিতাও হতে পারে। পাঠক সাবধান। গুটিয়ে রাখুন, যদি থেকে থাকে, কবিতা পাঠের আলখাল্লায় কোনও ভদ্র সমাজের আত্মশ্লাঘা। পড়তে পড়তে ছোবল পাবেন। ‘চাঁদের আলোয় সায়রা বানুর শরীর ভেজে’ যতটা লাগবে, প্রায় ততটাই, বা তাঁর চেয়ে
বেশি ‘শক’ পাবেন, লিফটে চড়তে চড়তে অনিমেষের
অভিব্যক্তির গপ্পে। জয়াশিষ আরও অনেক লিখুন, এরকমই লিখুন, শুভেচ্ছা
থাকলো। কর্কট ছাড়া আর কোনও শক্তির কাছে হার না মানা সম্প্রতি প্রয়াত এক লেজেণ্ডের
মুখ বারবার ভেসে উঠল সৌভিক সিনহার কবিতা পড়তে গিয়ে। নিখুঁত শব্দচয়ন, স্মার্ট উপস্থাপনা ছাড়াও সৌভিকের কবিতাকে অন্য মাত্রায়
নিয়ে গেল ‘ট্যানজেন্টকে প্রায় শূন্য করার দিকে মন দিই’, ‘তুলোর ঘোমটা পরে উড়ে যাব’ এইসব পঙক্তি। সাবাশ সৌভিক। তুলনায় চন্দ্রনীভ সরকারের
লেখা খুব সহজ, সরল। তাই ‘দ্বিচারিণী, তোমার দ্বিচারিতাকে আঁজলা করে নিয়েছি’ এতো পরিষ্কার একটা উচ্চারন দিয়ে কবিতা শুরু করতে পারেন
কবি। তারপর নিজের বেগে কবিতা এগোয়। অন্ধ মানুষ, হাঙ্গর, নাবিক পরপর চলে আসে। কবি
তখন একটা। কখনো ঈর্ষাকাতর, কখনো মৃত।
যন্ত্রণা বিভিন্ন মোড়কে চলে আসে সহেলী ঘোষের কবিতায়। তাই ‘তলপেটে কুঁকড়ে থাকা ছ-মাস’-এর যন্ত্রণা একটু বড় হয়ে পোশাক পরে নিয়ে ‘ফুটপাথ থেকে পেনকিলার’ তুলে খায়’। ‘এবার অন্তত আসামীদের চোখে শীতঘুম আসুক’ কি অসম্ভব তলানিতে পৌছলে আর্তি সম্ভব, তা বোধ করি বুঝতে সময় লাগবে না পাঠকের। একটা অদ্ভুত
শ্লেষ দেখা যায় অভিনন্দন পাঠকের লেখায়। মনে হয় ‘সাপ’ আর ‘চোর’বোধহয় একটি রূপান্তরের দুটি রূপ। কেন ‘টয়লেট থেকে কেউটে বেরিয়ে আসে’, তা বুঝতে গিয়ে তা পাঠকের দুবার ভাবতে হবে না। কবির
ভাবনাকে হ্যাটস অফ। আর ভাবনা ও আঙ্গিকের জন্য ঠিক পরেই জোরালো প্রশংসার দাবি রেখে
গেলেন অভ্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়। ‘সহাবস্থান’ কেন কিছু অতিকথন দিয়ে শুরু হয়েছিল, পড়তে পড়তে বোঝা গেল। ‘চোখ বুঝলেই সারি সারি শিকড়ের দলে যে লবটুলিয়া দাড়িয়ে থাকে’ অভ্রদীপকে ধন্যবাদ তার সন্ধান দেওয়ার জন্য। ঠিক বাতসল্য
নয়,
একটু যেন শীত-শীত করবে শীর্ষ তনয় ঘোষের‘সন্তান’ পড়লে। ‘বড়
দুঃস্বপ্ন’ দেখার এলিজি
কান্না হয়ে বেরোয় ‘খোকা, জামাটা খুলে শো, এই আর্তি’তে। দীপায়ন দত্তর ‘মেঘের বাড়ি’ আরেক প্রাপ্তি। ‘চরমে তার অভিলাষের মায়া, দু’চোখে তার সেলোফোনের বাতি/কেবলই তার মেঘের বাড়ি জুড়ে ভিজে
বালিশ,
গোপন মাতামাতি’। সাবলীলতায়
দীপায়নের লেখা প্রথম সারির। ‘আবর্ত’তে অনুপম ভট্টাচার্য এক
নিখুঁত দৃশ্যকল্প তুলে ধরেছেন। বন্ধ খাম খুমে ছেলেটি কী খুঁজে পেল, জানার আগ্রহ রইল। একটা অদ্ভুত ভালো লাগা ছড়িয়ে পড়ে
সাগরিকা ঘোষের ‘অভিভাবক’ পড়ে। ভাষার প্রতি কবির দায় চিরন্তন হোক, দেখা দিক ‘বাংলাভাষার ঈশ্বর’। বেশ নজরকাড়া কিছু ছান্দিক
ওঠানামা ধরা পড়ে সৌম্যদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কয়েক বছর বাদে লেখার কবিতা’য়।‘প্রচারবিমুখ অপেক্ষা নশ্বর’ একটা নিটোল গল্পের মতো সুর তৈরি করে। পড়া শেষ করেও
বারবার কানে রেসোনেন্স তোলে – ‘একটুখানি জল, সোহাগী আয় সোহাগী আয়’। প্রায় নিখুঁত দুটি লেখা শাশ্বতী সরকারের। দীর্ঘ ‘অপেক্ষা’র পর একটা সময়ে ‘ভালো থাকে নদী’। ‘ভেতরে প্রদীপ’ জ্বালানোর আর্তি ভেতর থেকেই আলো জ্বেলে দেয় কবির
লেখনীকে। বেশ অন্যরকম আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ভৌগলিক’। পঙক্তিতে মুন্সিয়ানা চোখে পড়ার মত। ‘তোমার চারপাশে ঘরে যারা, তাদের তুমি দুটো দিকই দেখতে পাও’। উত্তয়াধিকারের আকাশে এক
রহস্য-ভ্রমণ, সন্দেহ নেই।
সবমিলিয়ে বলা যায় নীলকণ্ঠ
প্রকাশন থেকে বেরনো ‘উত্তরাধিকার’ বাংলা ভাষা ও কবিতা থেকে তথাকথিত সন্দিহান মননদের পুনরায় তাদের মনোরথে
অধিষ্ঠিত করার অঙ্গীকার। বাংলা কবিতার পাঠক আগেও কম ছিল, এখনও কম। তা বলে লেখালেখির গুণাগুণ কমে না। মাত্র ত্রিশ
টাকার বিনিময়ে ২০১৫-র কলকাতা বইমেলার ঠিক আগে মুষ্টিমেয় সিরিয়াস কবিতাপ্রেমীদের
কাছে এ বই এক অনন্য উপহার হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সন্দেহ নেই। ‘উত্তরাধিকার’ ‘কালবেলা’র দিকে যাক, আশা রাখি।
মন ভালো হয়ে গেলো পড়ে ।
ReplyDelete