পুজোর অপেক্ষা
বাড়ির পুজোর যে নিষ্ঠা থাকে, যে প্রাণ থাকে,
ভক্তি থাকে মায়ের ওপর, বারোয়ারীর ক্ষেত্রে সেটা আশা করা যায় না। তবু যখন
প্যান্ডেলে বাঁশ খাটানো হয়, তখন থেকেই মনের ভেতরে ঢাক বাজতে থাকে। এই অনুভূতি
কমবেশি সব বয়সীদের ক্ষেত্রেই হয়। ছোটদের প্রাণের প্রকাশ বেশি হয় বলে, তা চোখে পড়ে।
এরপর সারা দিন ধরে, এমন কি সারা রাত ধরেও ঠুকঠুক একটা শব্দ কান থেকে যেতে চায় না।
একটু একটু করে কাপড়ের মোড়ক জড়িয়ে তৈরি হচ্ছে প্যান্ডেল। আজ কতটা হল, কাল আর কতটা
কাজ শেষ হবে, পুজোর আগে যেমন চেয়েছি তেমনটা করতে পারবে তো মিস্ত্রী- এই চিন্তা
শুধু উদ্যোক্তাদের নয়, প্রায় সকলেরই। এবারের প্যান্ডেল যেন আগের বারের মত অত খুললো
না, বা এবারের প্যান্ডেল এখানকার সেরা- এই কমন আলোচনা মুখে মুখে। এরপর প্রতিমা আর
লাইটের রেষারেষি। কে দুঃস্থদের কটা কাপড় বিলি করল, কে ভুরিভোজ খাওয়ালো- এই
প্রতিযোগিতা গিলে খাচ্ছে যেন পুজোকে। আসলে দুর্গাপুজো তো শুধুমাত্র পুজো নেই, এক
আনন্দলীলার প্ল্যাটফর্ম হয়ে গেছে। শুধু মেতে থাকা আর মাতিয়ে রাখা।
আর যাঁরা ভীড়ভাট্টা পছন্দ করেন না, এই পুজোর
ছুটিতে তাঁরা বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে বেড়াতে বেরিয়ে পড়েন। এও এক ধরনের পুজোর উল্লাস।
সারা বছরের একঘেয়েমি কাটিয়ে নতুন উৎসাহে আবার জীবন শুরু করার তাগিদ থাকে এই
ভ্রমণে। আর পুজোকে কেন্দ্র করে যে সাহিত্যের পত্রিকাগুলি মেতে ওঠে, সেও দেখার মত।
ছোট, বড়, মাঝারি পত্রিকাগুলোর শারদ সম্ভারে ভরে যায় বইয়ের দোকান। আর ব্লগজিন বা
ওয়েবজিনগুলোও পিছিয়ে নেই এই দৌড়ে। শারদীয়ার এই লেখালেখিতে যদি উৎকর্ষতা খুঁজতে
চান, তাহলে ঠকবেন। আসলে এও এক উৎসব আমাদের দুর্গাপুজোকে ঘিরে।
এই
সময়ে কেনাকাটার যে ধুম ওঠে, তাকি কোন উৎসবের থেকে কম? বাঙালি জামাকাপড় কিনছে, জুতো
কিনছে, তোয়ালে গামছা কিনছে, খাটবিছানা কিনছে, সোনা কিনছে, পারলে সারা পৃথিবীকে
কিনে নিতে চাইছে। সমস্ত জাতির থেকে বাঙালি কেনাকাটায় ফার্স্ট হয় এই সময়ে।
ব্যাবসাদারদের কপাল ফেরে। আবার যে সব ছোট ব্যাবসায়ীরা সারা বছরের সেরা দাঁও মারবে
বলে মুখিয়ে থাকে, তাদের হয়ত বড় বড় মলের ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার মত ক্ষমতা থাকে না
বলে চুপসে যেতে হয়। কারুর কারুর তো নতুন জামা এই সময়ে বছরে একবারই কেনা হয়। আর কেউ
বা, না কিনতে পেরে চোখের জল চেপে রাখে। তাদের তখন বারোয়ারীর বিলনো কাপড়ের ওপর ভরসা
করতে হয়। তাও তো কেউ কেউ পরতে পারে না নতুন জামা। একেক সময়ে মনে হয়, মা তুমি তো
ত্রিনয়ন দিয়ে দেখ, এদের দেখতে পাও না?
আর যা না বললেই নয়, নতুন জামাকাপড়ে সেজে
গুজে, ঘরদোর সাফসুতরো করে এই দুর্গাপুজো পালন আসলে ঠিক পুজোকে ঘিরে নয়, এ আমাদেরই
নতুন হওয়ার চিরকালীন আকাঙ্ক্ষা। বর্ষার ভিজে দিনগুলো কেটে আকাশের সাদা মেঘ আর সোনা
রোদ আমাদের যে পরমাণে আহ্লাদিত করে, তা আর বলার নয়। মনে হয় যেন শরীরের জমা শ্যাওলা
মুছে গেল। ওই আকাশ যেন আমাদের সবাইকে পাখি করে দিতে চাইছে, ওই রোদ যেন বলছে, সোনায়
মুড়ে দিলাম তোমায়! আমাদের নতুন জীবন এলো, আর কাশফুল নিষ্পাপ হেসে আমাদের পিঁড়ি
পেতে বসতে দিল। স্থলপদ্ম আর জলপদ্ম- কে বেশি সুন্দর, এই প্রতিযোগিতায় ওরা যায় না
কখনও। যেমন শিউলির গন্ধে বেশি আকুল হই না হলুদ ছোপানো বোঁটায় ওর সাদা রূপ বেশি
খোলে- এই দ্বন্দ্বেও আমরা যাই না। প্রকৃতি পুজোর পটভূমিকা তৈরি করে রাখে, আর আমরা
এই অকাল বোধনে মেতে উঠি।
অপূর্ব ...
ReplyDeleteধন্যবাদ
ReplyDelete