কি রী টী সে ন গু প্ত
সাহিত্যের মূল ধারার পাশাপাশি গড়ে উঠছে অল্টারনেটিভ লিটারেচার। দলিত শ্রেণীর সাহিত্য এর অন্তর্ভুক্ত। এবং সমকামী, ট্রান্সজেন্ডার, ট্রান্সসেক্সুয়াল মানুষদের নিয়ে লেখালিখি, তা সে গল্প হোক বা কবিতা এই অল্টারনেটিভ সাহিত্যের মধ্যেই পড়ে। দলিত সাহিত্যের লেখককে আমরা দলিত সাহিত্যিক বা লেখক বলি। তাহলে সামগ্রিকভাবে অল্টারনেটিভ সাহিত্যের লেখককে আমরা অল্টারনেটিভ সাহিত্যিক বা কবি বলতেই পারি। আপত্তির কিছু আমি তো দেখি না। প্রায় বছর দুয়েক আগে আমার লেখা একটি কবিতায় সমকামের গন্ধ পেয়েছিলেন আমারই এক অগ্রজ কবি রণদেব দাশগুপ্ত। বলেছিলেন, "সেন্সিটিভ কবিতা হে। আজকাল সমকামীদের নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা হচ্ছে, লেখালিখি হচ্ছে। তোমার এই কবিতাটা রিস্কি।" আনন্দ আরেকটু বেড়ে গেলো যখন আরেক কবি আমার কবিতাটি স্বেচ্ছায় সম্পাদনা করে দিলেন। ঈষৎ শ্লথ কবিতাটি টানটান হয়ে গেলো। বাক পত্রিকার সম্পাদক অনুপম মুখোপাধ্যায়ের কথা বলছি। প্রকাশিত কবিতাটি পড়ে দেখুন, প্রিয় পাঠক -
চোখ বড় হলে মনে করি
আধ বুজে শুয়ে আছি
যেন এসেছিলি তুই
অনেক রাত ... অনেক রাত
ঘুমোতে পারিনি
পেয়েছি তোকে
তবু জ্বলেনি প্রদীপ
জ্বলেছে তেল আর
সলতে সিঁদুর
যেন ঘুম হয়ে এসেছিস তুই
ভরা বীর্যে জেগে আছে
তারাগুলো আর
অনেক রাত ... অনেক রাত
আমার সদ্য
প্রকাশিত ননফিকশনাল
মেময়ার "দ্য রিভার্স ট্রি"তে এই
কবিতাটির ইংরেজি
ভার্সান রেখেছি।
ইংরেজি অনুবাদ
ভাববেন না
যেন। সাধারণত
কবিতা লেখার
সময় আমি
দুটো ভাষাতেই
লিখি। ভাষা
এবং পাঠকের
কথা ভেবে
দু-এক জায়গায়
অল্প পরিবর্তন
করতে হয়, কিন্তু মূল ভাবটি
একরকম থাকে।
যেমন ইংরেজি
কবিতায় "ভরা বীর্যে জেগেছিল তারাগুলো"-র জায়গায় চাঁদের
কথা লিখেছি।
চাঁদ এবং
বীর্যের কোনো
বিজ্ঞানসম্মত যোগাযোগ
নেই, অথচ দেখুন
বিশ্বের অন্যতম
একটি ধর্মীয়
গ্রন্থে এই
যোগাযোগের স্বীকৃতি
আছে। ধর্ম
এবং বিজ্ঞানের
সংঘাতের গল্প
লিখতে বসিনি, বন্ধু। তাই এই
আলোচনায় আপাতত
ইতি।
সেই ২০০৫
সাল থেকে
ওয়েস্ট বেঙ্গল
ডেন্টাল সার্ভিসে
আছি। কর্মসূত্রে
বাড়ির ভাত-জলের মায়া ত্যাগ
করে দিনের
পর দিন
বাইরে বাইরেই
থাকতে হয়
আমাকে। কখনো
সরকারি আবাসে, আবার কখনো অল্প
খরচের লজে।
২০১০ সালের
কথা। বাঁকুড়ার
লালবাজার অঞ্চলের
একটি লজে
ছিলাম বছরখানেক।
একদিন সন্ধে
নাগাদ লজের
ভেতরেই এক
যুবতীর সঙ্গে
আলাপ হলো, নাম লিরা। দেখতে
শুনতে বেশ
আকর্ষণীয়, ছিপছিপে, লম্বা, কোমর ছাড়ানো
এক ঢল
চুল, কেবল কণ্ঠস্বর
কিছুটা কর্কশ।
প্রথম আলাপে
বেশ মিশুকে
মনে হলো।
স্বাধীনচেতা লিরা
পরিচয় পর্ব
শেষ হওয়ার
সময় নিজের
থেকেই প্রস্তাব
দিলো, "যখন ইচ্ছে হয় আমার
ঘরে আসবেন, দাদা। আমি কিন্তু
আপনাকে দাদা
ডাকবো, ডক্টর সেনগুপ্ত
নামটার ওজন
বড্ড বেশি।
আপনার আপত্তি
নেই তো?" আমি সানন্দে সম্মতি
জানাতে লিরা
নিজের ঘরে
চলে গেলো।
একটা খচ-খচ
তবু গেলো।
বাঁকুড়ায় শহুরে
হাওয়া, বিশেষত মেট্রোপলিটন
কালচার এখনও
তেমন দাগ
কাটেনি। এই
মেয়ে এখানে
কী করছে? মনের কৌতূহল মনেই
পুষে রাখতে
হলো। এরপর
আরেকদিন সকাল
সকাল লজের
অফিসঘরের সামনে
দেখা হলো
লিরার সঙ্গে।
সেদিন সন্ধের
মেকআপ আজ
নেই এক্কেবারে।
তবু কতো
সুন্দর দেখাচ্ছে
ওকে। চোখাচুখি
হতেই এক
গাল হাসি, "কেমন আছেন, দাদা? আজকাল আমার
ফিরতে বেশ
দেরি হয়ে
যাচ্ছে, আপনার সঙ্গে
আড্ডাটাই হচ্ছে
না আমার।" বললাম, "এই চলে যাচ্ছে আর
কি! জানেনই তো
দুপুর তিনটের
পর থেকে
আমার অখণ্ড
অবসর। কাজের
কোনো বালাই
নেই। বাঁকুড়াতে
ইচ্ছে হলেও
একটা মুভি
দেখতে পারি
না। এখানকার
সিনেমা হলগুলো
দেখেছেন আপনি?"
"আমি দেখেছি, দাদা। এসব হলে
আপনারা পারবেন
না। আমাকে
যেতে হয়, কিছুটা বাধ্য হয়েই
যাই বলতে
পারেন।" লিরার ঠোঁটের কোণে একটু
যেন বিরক্তির
রেখা। কথা
আর বাড়লো
না। সকাল
নটায় হাসপাতালে
না ঢুকলে
লেট হয়ে
যেতে হবে।
আমি ছুটলাম
আমার কর্মস্থলের
উদ্দেশ্যে।
সত্যি বলতে
কি, প্রথমদিনের আলাপে
লিরা যে
প্রস্তাব আমাকে
দিয়েছিল, ইচ্ছে মতো
ওর ঘরে
যেতে, আমি কোনোদিনও
ট্রাই করিনি।
যতোইহোক, একদিনের পরিচয়ে
হঠাৎ করে
এক যুবতীর
ঘরে হাজির
হবো, বিষয়টা আমার
বেশ রিস্কি
মনে হয়েছিল।
তাছাড়া, মেয়েটি কি
করে-না-করে, বাড়ি কোথায়, ইত্যাদি জানা
থাকলেও না
হয় হতো।
মেরেকেটে দুদিন
মিলিয়ে ঘণ্টা
দুইয়ের পরিচয়।
ঘরের বাইরেই
থাকুক এই
যোগাযোগ এমনটাই
মনঃস্থির করেছিলাম।
বিধাতা মুচকি
হাসেন নাকি, এমনই বলেন অনেকে।
আমাকেও বলতে
হচ্ছে। অগত্যা!
তারিখ এবং
সময় এখনও
পরিষ্কার মনে
আছে। ১৪ই
জুন, রাত এক-টা
দশ মিনিট
নাগাদ আমার
ঘরের দরজায়
ধাক্কা দেওয়ার
আওয়াজ। যোগশাস্ত্র
বিষয়ক একটি
রচনার অনুবাদ
করছি তখন।
খুব বিরক্ত
হলাম। এই
লেখালিখির কাজের
মধ্যে কোনো
ব্যাঘাত আমি
মেনে নিতে
পারি না।
তাই দরজার
আওয়াজটা কানে
না তুলেই
নিজের কাজেই
মন দিলাম।
কয়েক সেকেন্ড
পরে আবার
সেই শব্দ।
ফট করে
মেজাজ চড়ে
গেলো। কে
এসেছে এতো
রাতে? কী দরকার? ল্যাপটপ খোলা
রেখেই বিছানা
ছেড়ে দরজা
খুলতে যাব
কানে এলো
চাপা কান্না।
কেউ মনে
হয় ফুঁপিয়ে
কাঁদছে। দ্রুত
এগিয়ে গেলাম।
দরজা খুলতেই
দেখি লিরা
ফুঁপিয়ে কেঁদে
চলেছে। "আপনার সঙ্গে কথা আছে, দাদা। আমার খুব
ব্যথা করছে।"
"ভেতরে আসুন, লিরা"। লিরা ঘরে ঢুকতেই
দরজাটা বন্ধ
করে দিলাম।
অন্য ঘরের
কেউ দেখলে
সকালের মধ্যেই
রটে যাবে
অনেক কিছু।
বস্তুত এই
লজের প্রায়
প্রতিটি গেস্ট
পার্মানেন্ট। ওরা
চেনেন আমাকে।
জানেন আমি
কি করি, কোথায় চাকরি করি, ইত্যাদি।
লিরার পরনে
একটি হলুদ
রঙের স্লিভলেস
ভেস্ট আর
শর্টস। টাইট
করে পেছনে
বাঁধা চুল।
সম্ভবত একেই
হর্সটেইল বলে।
আজ গায়ের
রঙ কেমন
ফিকে দেখাচ্ছে।
যন্ত্রণার নীল
সারা চোখেমুখে।
জিজ্ঞাসা করি, "কী হয়েছে বলুন ?" লিরার মুখে কোনো
উত্তর নেই।
শুধু গোঙানির
শব্দ। মুহূর্তের
মধ্যে গেঞ্জিটা
চিবুকের দিকে
টেনে তুলে
ধরলো। বেকায়দায়
পড়ে গেলাম।
এক যুবতী
গভীর রাতে
আমার ঘরে, এখানে আর কেউই
নেই। হাসপাতালে
বিশেষ দরকার
পড়লে নার্স
আছেন, ওদের সামনে
মহিলা রুগীর
ফিজিক্যাল পরীক্ষা
নিরীক্ষা করা
হয়ে থাকে।
কার মনে
কী আছে, আমি জানি নাকি? আজকাল হচ্ছেও তো
অনেক কিছু।
মেয়েলি বিষয়ে
বদনাম চাকরি
জীবনের অনুকুল
নয়, সবাই জানে। "আহা, মুখে বলুন
কী হয়েছে
আপনার। তারপর
না হয়..."
আমার কথা
শেষ হওয়ার
আগেই লিরা
বলে উঠলো, "দাদা, আপনি নিশ্চিন্ত
থাকুন। আপনাকে
বদনাম করতে
আসিনি আমি।
দাদা ডাকি
আপনাকে। আপনি
না দেখলে
আমার ব্যাপারটা
বুঝবেন না।" আমার চোখের সামনে
ওর রক্তাক্ত
ডান স্তন
অনাবৃত। অনেকক্ষণ
ধরেই ব্লিড
করেছে, রক্ত বেশ
কিছুটা জমাট, চাকা-চাকা দাগ
হয়ে আছে।
এরিওলার ধার
থেকে চুয়ে
চুয়ে রক্ত
বার হচ্ছে। "কীভাবে হলো এসব? কোথাও চোট পেয়েছেন?"
"দাদা,
আমার ডান
দিকের বুকে
সিলিকন ইমপ্ল্যান্ট
বসানো হয়েছে
সপ্তাহ দুয়েক
হলো। বাঁ-দিকে বছর খানেক
আগেই বসানো
হয়েছে। আমি
ট্রান্সজেন্ডার, এখন যৌনকর্মী
হিসেবে কাজ
করি।" ট্রান্সজেন্ডার আর যৌনকর্মী এই
দুটো শব্দ
আমার অচেনা
ছিলো না।
প্রায় চোদ্দ
বছরের পেশাদার
জীবনে বেশ
কয়েকবার ওদেরকে
পেয়েছি আমার
চেম্বারে। কিন্তু্
সেদিন চোখের
সামনে প্রায়
অর্ধনগ্ন, যন্ত্রণাকাতর একটি
ট্রান্সজেন্ডার যুবতীর
অভূতপূর্ব মায়াচ্ছন্নে
ছিলাম, এটা বলাই
বাহুল্য। যাইহোক, চটপট ফার্স্টএডের ব্যবস্থা
করে, ব্যথা কমানোর
একটা ওষুধ
দেওয়া হলো।
বললাম, "আজকের রাতটা কেটে গেলেই
আগামীকাল আপনার
সার্জেনের পরামর্শ
নেবেন। প্রয়োজন
হলে, ওকে দেখিয়ে
আসবেন।"
"আমি কালকে যাব
না, দাদা। ডাক্তারবাবু
আমাকে যাতা
বলবেন। উনি
নিষেধ করেছিলেন, মাস খানেক কোনোরকম
যৌন কাজকর্ম
না করতে।
যদি কালকে
যাই প্রচুর
বকা খেতে
হবে।"
"বকা খে্লে খাবেন, কিন্তু দেখিয়ে নেওয়াটা
জরুরী, লিরা। ভবিষ্যতে
কোনো সমস্যা
হলে শরীর
আপনাকে ছেড়ে
কথা বলবে
না। কাজেই
দেখিয়ে নেবেন।
এতে আপনারই
মঙ্গল"।
লিরা রাজি
হলো। রাত
জেগে লেখালিখির
কাজ করি
বলে ফ্লাস্কে
ব্ল্যাক কফি
রেখে দেওয়ার
অভ্যেস আমার
অনেকদিনের। জিজ্ঞাসা
করলাম, "কফি খাবেন?
দুধ নেই
এখানে। তবে
ইচ্ছে হলে
চিনি মেশাতে
পারেন"। লিরা ব্ল্যাক কফিতে
যথেষ্ট স্বচ্ছন্দ
মনে হলো।
আমার ঘরে
শোওয়ার খাটটুকু
ছাড়া আসবাব
বলতে ছোট্ট
একটা টেবিল
আর দুটো
চেয়ার। একটাতে
লিরা বসেছে, আমিও কফি মাগ
হাতে ওর
সামনে চেয়ারটা
টেনে বসলাম।
এক ঝলকে
দেখে নিলাম
ল্যাপটপ স্ট্যান্ড-বাই মোডে চলে
গেছে।
"কফিটা খেয়ে খুব
আরাম পেলাম, দাদা। ব্যথাটাও কম
মনে হচ্ছে।
আমার গল্প
শুনবেন আপনি? এই তো বলেন
আপনি লেখেন, আমার গল্প লিখবেন? কখনো সুযোগ পেলে
লিখবেন, আর হ্যাঁ, আমার নাম চেঞ্জ
করবেন না
প্লিজ। আমি
লিরাই থাকতে
চাই। শুধু
নাম কেন, আমি কিছুই লুকোতে
চাই না"। ফিকশন নভেল
লেখার ইচ্ছা
আমার কোনোকালেই
ছিল না।
হবে বলে
মনেও হয়
না। মানুষ
হয়ে আরেকজন
মানুষের সত্যি
ঘটনা শুনবো, জানবো ওর মতো
আরও লিরাদের
যাপন। এই
ভেবেই রাজি
হয়ে গেলাম।
আর লিরাও
শুনিয়ে চললো
ওর বৃত্তান্ত।
অতি সাধারণ
মধ্যবিত্ত পরিবারে
জন্ম। উত্তর
চব্বিশ পরগণার
হালিশহরে। জন্মের
আগেই পথদুর্ঘটনায়
লিরার বাবা
মারা যান।
রাজ্যসরকারি কর্মচারী
হওয়ার সুবাদে
বাবার চাকরিটা
পেয়ে যান
মা, সার্ভিস অন
কম্প্যাশনেট গ্রাউন্ডে।
দশটা-পাঁচটার ডিউটি।
ছেলের নাম
রাখা হয়েছিল
মোহন। মোহন
সেই ছোট্ট
বয়স থেকেই
মেয়েদের সঙ্গে
গল্প করতে, খেলতে পছন্দ করতো।
পাড়ার সমবয়সী
মেয়েদের মধ্যেই
ওর অবাধ
যাতায়াত ছিলো।
ক্লাস নাইনে
পড়াকালীন একটু
একটু করে
বুঝতে পারতো
যে ওর
শরীরে একটা
মেয়ে চাপা
পড়ে আছে।
বহিরঙ্গে পুরুষ
হলেও হাঁটাচলা, ওঠাবসা, কথাবলা - এই সবকিছুই
মেয়ে-মেয়ে হতে
শুরু করলো। সমবয়সী ছেলেরা ওকে
দেখে হাসতো, নানারকম মন্তব্য
করতো, তবু সেই
সবের কোন
দাগ ওর
মনে ছিলো
না। খুব
যত্নে মেয়েসত্ত্বাটিকে লালন করে
চলেছিল মোহন।
কলকাতার বঙ্গবাসী
কলেজে পলিটিকাল
সাইন্সে গ্রাজুয়েশন
পড়াকালীন আলাপ
হয় সুমিতের
সঙ্গে। লম্বা-চওড়া চেহারার সুমিতের
সঙ্গে লিরার
ভাব জমতে
বেশি সময়
লাগেনি। সুমিত
বেশ জানতো
ওর বন্ধুর
সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনের
বিষয়। ওদের
মধ্যের বন্ধুত্ব
পুরোদস্তুর ভালোবাসায়
পরিণত হতে
সময় লেগেছিল
ছমাস। লিরার
আনন্দের শেষ
ছিলো না।
তারিয়ে তারিয়ে
ভোগ করতো
ওর বয়ফ্রেন্ডের
খুনসুটি, মেজাজ, ভালোবাসা, আদর, আর সর্বোপরি
পৌরুষ। মাসের
এক-দুদিন ঘুরে
আসতো কাছাকাছি
ট্যরিস্ট স্পট
থেকে। পছন্দের
জায়গা ছিলো
দীঘা। বোলপুরের
কোপাই নদীর
ধারেও কাটিয়েছে
কতো রাত।
মন আর
শরীর মিলেমিশে
এক হয়ে
গেছিল যেন।
সুমিত কথা
দিয়েছিল লিরাকেই
ওর জীবনসঙ্গিনী
করবে। বলেছিল
সময় মতো
বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে আলাপ
করিয়ে দেবে।
গ্রাজুয়েশনের পরে যোগাযোগ স্বাভাবিকভাবেই
কমতে থাকে।
একটা প্রাইভেট
কোম্পানিতে চাকরিও
পেয়ে যায়
সুমিত। ক্রমশ
বাড়তে থাকে
দূরত্ব। প্রথমে
প্রতিদিন ফোনে
কথাবার্তা, এস এম
এস চালাচালি, ভালোবাসার ডালি
উজার করা
প্রেম ... সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চার-পাঁচদিন অন্তর দিনে
একবার ফোন।
কখনো বা
সপ্তাহে একবার।
দেখা সাক্ষাৎ
বন্ধই হয়ে
গেছিল ওদের
মধ্যে। হাঁপিয়ে
ওঠে লিরা।
একদিন, এক মুহূর্তের
জন্যে দেখা
করতে মরীয়া
হয়ে ওঠে।
ততোধিক নির্বিকার
সুমিত। ওর
এই উদাসীনতা
লিরাকে কুড়ে
কুড়ে খাচ্ছিলো।
এমনটাই চলতে
থাকে। মাস
দুয়েক পর
হঠাৎ একদিন
সকালে সুমিত
টেকস্ট করলো। "আমি দুঃখিত। আমার
বাড়িতে তোমাকে
নিয়ে যাওয়া
সম্ভব হবে
না, আমার মা-বাবা তোমাকে আমার
পার্টনার হিসেবে
কোনোদিনই মেনে
নিতে পারবেন
না। আমাকে
ভুলে যেও।
আমার থেকে
অনেক ভালো
সঙ্গী তুমি
পেয়ে যাবে"। ভেঙে পড়লো
লিরা। মাস্টার্স
পড়ার ইতি
ওখানেই। প্রায়
ছমাস স্বেচ্ছায়
ঘরবন্দী হয়ে
নিজের সঙ্গে
নিজের বোঝাপড়া
করে নেওয়া।
দুটো মারাত্মক
সিদ্ধান্ত নিলো।
প্রথম - ব্রেস্ট অগমেনটেশন, দ্বিতীয় - যৌনকর্মী হিসেবে
আয়সংস্থান। মোহন
থেকে লিরার
এই নাটকীয়
ট্রানজিশন যে
সহজ ছিলো
না সেটা
বুঝে নিতে
দেরি হয়
না।
বস্তুত পুরো
ঘটনাটা যখন
শুনছি লিরার
মুখ থেকে
আমি ওর
এই দুটি
সিদ্ধান্তের কোনোটির
সঙ্গেই সহমত
হতে পারিনি।
কিন্তু আমার
একমত হওয়ার
থেকেও গুরুত্বপূর্ণ
হলো আমার
সামনে বসে
থাকা মানুষটির
সিদ্ধান্তকে সম্মান
জানানো। এতক্ষণে
আমার কাছে
পরিষ্কার হলো
লিরার বাঁকুড়াতে
থাকার মূল
কারণ। এখন
বুঝতে পারলাম
কেন সেদিন
ঈষৎ বিরক্তি
নিয়ে বলেছিল
ওর ইচ্ছে
না থাকলেও
সিনেমাহলে যেতে
হয়। নিজেকে
একটু গুছিয়ে
নিয়ে জিজ্ঞাসা
করলাম, "আপনি ঠিক কী খোঁজেন
একজন পুরুষের
থেকে?" চমকে উঠেছিলাম ওর উত্তর
শুনে। লিরা
বললো, "আমি একজন পুরুষের শরীরে
গন্ধহীন-স্বচ্ছ ঘাম
খুঁজি। দাদা, আমিও চাই একটা
সুন্দর সংসার, স্বামী-সন্তান নিয়ে
আমার ভরা
পরিবার"।
লিরার এই
ঘাম-খোঁজা আমাকে
বহুবছর তাড়া
করে বেড়িয়েছে।
একজন মানুষ
অন্যের শরীরের
ঘামে মুক্তি
খোঁজে? এও সম্ভব? ঘাম সর্বদাই স্বচ্ছ
এবং গন্ধহীন
হয়। কিন্তু
লিরার কথায়
ওই দুটো
শব্দ উল্লেখের
দাবী রাখে
কী? সাত-পাঁচ ভাবতে
ভাবতে একদিন
লিখেই ফেললাম
গোটা একটা
গদ্য কবিতা।
মনে আছে
কবিতাটির নাম
ছিলো "ফেটিশ"। পাঠক, পড়ে দেখুন -
ঘরের বাইরে পা রাখলেই একটা-না-একটা সুগন্ধি চাই। যে গন্ধ নিজের,
আমার শরীরের, তাকে ভয় পাই। স্বেদের ঘ্রাণ বড়ো মায়া। সন্ধি,
মাস, ভক্তি,
মায় বালিশের কথা বলে। কবিতা লেখায়। ট্রেনে-বাসে, ঘুরতে-ফিরতে কবিতা এলে বিপদ। আশেপাশের সব লোক আমার,
এমন ভেবে নেওয়াই যায়,
কিন্তু ওদেরও তো মন আছে,
মান আছে। স্বেদ বড়ো বালাই। গন্ধ
... গন্ধটা
ভুলে থাকা - সুগন্ধি বড়ো দাওয়াই।
সেদিনের ওই
রক্তারক্তি ঘটনার
কারণও জেনেছিলাম।
পুরুষ সঙ্গীর
অমানবিক যৌনখিদের
কাছে হার
মেনেছিল সদ্য
অপারেশন-হওয়া-স্তনের কাঁচা
সেলাই। প্রথমে
ফিনকি, পরে চুয়ে
চুয়ে বেরিয়েছিল
তাজা রক্ত।
চমৎকার বলেছিল
লিরা, "স্তন প্রকৃতিপ্রদত্ত হোক বা
সার্জারির ফসল, পুরুষের হাত শুধু
ছুঁয়ে নয়, ডলে-ডলে বুঝে নিতে
চায় নারীত্বের
নরম"।
জানি না
লিরা আজ
কোথায়। কেমন
আছে ও, জানা নেই আমার।
ফোন নাম্বার
পালটে গেছে, বাঁকুড়াতে থাকে
না -- এটুকুই জানি।
ইচ্ছে হয়
ওকে একবার
দেখে আসি।
জেনে আসি
লিরা তার
পছন্দ মতো
পার্টনার পেয়েছে
কিনা। নাকি
আজও যৌনকর্মী
হয়ে কাজ
করে চলেছে
অক্লান্ত অধ্যাবসায়ে।
আমার সাম্প্রতিক
বই "দ্য রিভার্স ট্রি"তে এই
আখ্যান পুরোটাই
লিখেছি। বইটির
আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের
আগে আমার
ইভেন্ট ম্যানেজার
মোনা সেনগুপ্তকে
জানিয়েছিলাম, "আমি চাই কবি বা
সাহিত্যিক যেই
থাকুন না
কেন, বইটি প্রকাশের
সময় "এল জি
বি টি"-র কোনো সক্রিয়
সদস্য যেন
উপস্থিত থাকেন"। মোনা কথা
রেখেছিলেন। উপস্থিত
ছিলেন দুজন
সক্রিয় সদস্য।
পবন ঢল
এবং মধুজা
নন্দী। মধুজা
ট্রান্সজেন্ডার। ওর
থেকেই জেনেছিলাম
পুরাকালে শ্রীরামচন্দ্র
আশীর্বাদ করেছিলেন, "কলিযুগে তোমরা
আদৃত হবে"। এসব পৌরাণিক
আখ্যানে আমার
বিশ্বাস কম।
নিছক গল্পকথা
বই আর
কিছু তো
নয়। শুধু
কলিযুগে কেন, যুগে-যুগে লিরা-মধুজারা সম্মানিত
হন আমি
চাই। আমি
চাই- শুধুমাত্র গে, ট্রান্সজেন্ডার অথবা ট্রান্সসেক্সুয়াল নয়, মানুষ হিসেবেও
ওরা সম্মান
পাক। ওদের
ব্যক্তিগত চাহিদা, ভালোবাসা নিয়ে
ওরা সসম্মানে
বেঁচেবর্তে থাকুক
মানুষের সমাজে।
0 comments:
Post a Comment