Friday, September 19, 2014

যা দেবী সর্বভূতেষূ
শাঁ ও লি  দে

পুরাণ অনুসারে দুর্গাপুজা নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে। কেউ কেউ মনে করেন দুর্গাপুজা প্রথম শুরু করেন শ্রীকৃষ্ণ। আবার অনেকর মতে ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু এই পুজা করেন। তবে আমরা অকাল বোধন’’এর গল্পটি-ই বেশী মনে রাখি ও সত্য বলে মেনে নি

আলোকচিত্রঃ শোভন বেরা

কাশ বাতাস এ শিউলি ফুলের গন্ধ ,কাশ ফুলের দোলা। নীল আকাশে সাদা মেঘ-এর ভেলা প্রতি মুহূর্তে জানান দিচ্ছে পুজো আসছে।আমাদের মন আনচান। ব্যস, মাঝে তো আর কটা দিন-ই।তারপর শুধু ছুটি আর ছুটি। সমস্ত বছরের দৌড় আর ক্লান্তি ভুলে মজা নিংড়ে নেওয়ার সময়। দোকানে উপচে পড়ছে চোখে পরার মত ভিড়।চ্যানেলে চ্যানেলে কাউন্টডাউন শুরু। যেদিকে চোখ যায় শুধু কিউ আর কিউ...মা আসছেন বলে কথা! পুরাণ অনুসারে দুর্গাপুজা নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে। কেউ কেউ মনে করেন দুর্গাপুজা প্রথম শুরু করেন শ্রীকৃষ্ণ। আবার অনেকর মতে ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু এই পুজা করেন। তবে আমরা অকাল বোধন’’এর গল্পটি-ই বেশী মনে রাখি ও সত্য বলে মেনে নি। কথিত আছে, যে  শিব ভক্ত রাবণের হাত থেকে বাঁচতে রাম দেবী পার্বতীর আরাধনা করেন। রাম শরৎকালে দুর্গার বোধন, চণ্ডীপাঠ ও মহাপুজার আয়োজন করেন। আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিন রাম কল্পারম্ভ করেন ও সন্ধ্যায় বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস করেন। মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী ও সন্ধিপুজার পরেও দুর্গার আবির্ভাব না ঘটায়, রাম ১০৮টি নীল পদ্ম দিয়ে মহানবমী পুজার পরিকল্পনা করেন। হনুমান তাঁকে ১০৮টি পদ্ম জোগাড় করে দেন। এই  ভাবে তিনি মর্তে দুর্গা পুজার প্রচলন করেন। আমরা মূলত বাঙালিরা এই দুর্গাপুজাকেই বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব মনে করি।এটা এতটাই জাঁকজমক পূর্ণ হয় যে এক পুজো শেষ হতে না হতে আমরা পরের বছরের অপেক্ষা করতে থাকি হৈ হুল্লোড় কেনা কাটা বাজি পটকা, নিয়ম ভাঙ্গাতেও যে এত আনন্দ আছে তা এই দুর্গাপুজা এলেই টের পাওয়া যায়। কেনাকাটা এই উৎসবের একটা অন্যতম অঙ্গ।পুজা শুরুর প্রায় এক মাস আগের থেকে চলে প্ল্যান প্রোগ্রাম। যেহেতু চার দিনের পুজা তাই কোন দিন কি পড়া হবে এই নিয়ে চলে জোড় অলোচনা। সেই সঙ্গে লং ট্যুর তো আছেই! দু মাস আগে টিকিট কাটা থাকলেই হল,ব্যাগ গুছিয়ে একবার বেড়িয়ে পড়লেই ব্যস আর নো চিন্তা! পুজোর আগ দিয়ে দোকানপাট গুলিতে পা রাখার জায়গা থাকে না।গরীব বড়লোক চেনার উপায় থাকে না। খুব গরীব মানুষেরাও সারা বছরের সঞ্চয় তিল তিল করে জমিয়ে রাখে এই সময়ের জন্য। সারা বছরের দুঃখ মিটিয়ে নেওয়ার তাগিদ থাকে বছরের ঠিক একটা দিন। সর্বস্য খুইয়েও সবার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য চেষ্টা করে বাড়ির একমাত্র উপার্জন শীল মানুষটি।বাচ্চা-বয়স্ক নির্বিশেষে সবাই মেতে ওঠে ছুটির আনন্দে। পাড়ায় পাড়ায় প্যান্ডেলের বাঁশ পড়লেই মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতির সঞ্চার হয়।ছেলে ছোকরাদের ব্যস্তটা বাড়ে চাঁদা আদায়ের হিড়িকে। কার কটা ড্রেস হল তা নিয়ে চলে চুলচেরা বিচার। পড়াশোনা প্রায় শিকেয় তুলে মন পড়ে থাকে এই শ্রেষ্ঠ উৎসবটির দিকে। সপ্তমীতে বন্ধুদের সাথে ঘোরা, অষ্টমী বাবা মায়ের ঘোরা, আর নবমী পাড়ায় বসে শুধু আড্ডা। ছোট ছেলে মেয়রা মেতে  ওঠে নকল বন্দুকে, বেলুনে। অনেক বৈপরীত্য ও চোখে পড়ে এই সময়ই।ঝলমলে পোশাক পড়া বাচ্চাটির দিকে লোলুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আরেক বাচ্চা,যে এই জগতের সব উৎসবের থেকে আনন্দের থেকে বঞ্চিত।আশ্চর্য লাগে ভাবতে যে সর্বশক্তিমান, দুর্গে দুর্গতিনাশিনী এই ব্যবধান কিন্তু আজও মেটাতে পারেনি। কি অদ্ভুত না! দুঃখের ও!

তবু এই পুজো আনন্দের, আশার, আবেগের। শরতের নীল আকাশ, কাশফুল, প্রতিমার কাঠামো, ধুনুচি নাচ, ঢাকের বাদ্য , সিঁদুর খেলা সব সব কিছু আমাদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। প্রতিটি মানুষ হাঁ করে  তাকিয়ে থাকে প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করার জন্য। সব চাওয়া না চাওয়া , সব পাওয়া না পাওয়া সব সব কিছু এই উৎসবকে ঘিরে। কত মানুষ আর তাদের কত কত স্বপ্ন!সব স্বপ্ন পূর্ণ করার এই তো সঠিক সময় কেনা কাটা হই হুল্লোড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চলে নানা পত্র পত্রিকা বের করার হুজুগ। বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক বহু পত্রিকা শারদ সংখ্যা বের করে এইসময়। লেখা দেওয়া নেওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। সম্প্রতি এতে নতুন নতুন পালক যুক্ত হচ্ছে যেমন ব্লগ জিনের মত অসংখ্য অনলাইন ম্যাগাজিন। সবাই অন্ততঃ একটা শারদ সংখ্যা বের করার জন্য উদগ্রীব থাকে।বড় বড় পাবলিশার্স তো বটেই পিছিয়ে থাকে না কিছু সাহিত্য পাগল পকেট মানি বাঁচানো ছেলে মেয়ের দলও।আর কিছু মানুষ অপেক্ষায় কাটায় শারদ সংখ্যা পড়ার জন্য। এই ট্রেন্ডটা বহু বছর আগে থেকেই চলে আসছে।আগেও মহালয়ার সময় থেকেই শুরু হত দিন গোনা। যদিও এখন পুজো আসার অনেক দিন আগেই বাজারে বেরিয়ে যায় পুজো সংখ্যা, তবু হলফ করে বলা যায় যারা সত্যি সাহিত্য ভালোবাসেন তারা আজও অধীর আগ্রহে বসে থাকেন এবং বই এর তাক ভরে ওঠে রকমারি পুজো সংখ্যায়। গরীব থেকে বড়লোক সবার কাছে নানা রূপে ধরা দেয় এই উৎসব। এক এক বয়সের কাছে এক এক মাত্রা আনে এই উৎসব। সবাই কিছু না কিছু নতুনত্বে ব্যস্ত এই সময়।চ্যানেলে চ্যানেলে পুজার আড্ডার সাথে পাল্লা দিয়ে চলে পুজার গানের সিডি প্রকাশের অনুষ্ঠান।কত নতুন গান আর নতুন পুরানো কত শিল্পী। সময়টা যদিও অনেক এগিয়ে গেছে বদলে গেছে তবু পরম্পরাগুলো থেকেই গেছে।সারা বছরে এখন অনেক বেশি কাজ হচ্ছে গান কবিতা সাহিত্য সব ক্ষেত্রেই,আগের মত ওই বছরে একটিবারের প্রতীক্ষার মজা আর নেই তবু যা আছে তাই বা কম কী! পুজো  সংখ্যার আলাদা একটা আমেজ আছেই,তাই না!

বিদেশেও কিন্তু এই পুজোর আলাদা মাত্রা আছে। বিদেশ জুড়ে এখন ভারতীয়দের বাস। আর তারা সারাবছরের ব্যস্ততা ও প্রিয়জনকে ভোলার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিদেশের মাটীতেই আয়োজন করেন বড় বড় সব পুজোর। সুদূর কুমারটুলি থেকে প্রতিমা উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।বিজয়া দশমীতে বাঙালী শিল্পী সমন্বয়ে বিজয়া সম্মিলনী।

দুর্গাপুজার একটি বিশেষ অধ্যায় হল কুমারী পুজা বর্তমানে যদিও কুমারী পুজার প্রচলন অনেক কমে গেছে। তবে কিছু জেলায় রামকৃষ্ণ মিশনের কুমারী পুজার প্রচলনরয়েছে এখনও।

উৎসবের মাস। অথবা মাস জুড়ে উৎসব। রেশ কাটতে চায় না শেষ হয়ে যাবার পড়ও। মন বসে না কোনো কাজে। আমেজ আয়েশের রেশ কাটাতে গা ঝেড়েঝুড়ে কোনমতে কাজে ফিরলেও মন পড়ে থাকে সেই মহালয়ার সকালে । এই ঘোরতর বিশ্বায়নের মাঝে দাঁড়িয়ে আজও কানে বাজে রেডিও তে শোনা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-র যা দেবী সর্বভূতেষূ শক্তিরুপেন সংস্থিতা, নমস্তস্যই নমস্তস্যই নমস্তস্যই নমো নমহ ভাল লাগে বড় ভাল লাগে!






0 comments:

Post a Comment